রাধেশ্যাম সরকার ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এর আগেও অন্য প্রতিষ্ঠানে প্রভাষক পদে চাকরি করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে দেখা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এবং মাস্টার্সের সনদ জাল করে নিয়োগ পেয়েছেন। এভাবে তিনি এই সময় বেতন বাবদ তুলে নিয়েছেন ১১ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০ টাকা। মাগুরা খাটর রামানন্দকাঠি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা। তিনি জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নেকটার) সনদ জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছেন। তিনি সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা বাবদ নিয়েছেন ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জালিয়াতি করে বড়াইর হাজী চেরাগ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন আবুল হাসেম। বেতন-ভাতা বাবদ তুলে নিয়েছেন ১৯ লাখ ১২ হাজার টাকা।
এভাবে বহু শিক্ষক জাল সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। এমন জাল সনদে চাকরি নেওয়া ৬৭৮ শিক্ষকের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই এমপিওভুক্ত। এই তালিকা ইতোমধ্যে শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠিয়ে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বেতন-ভাতা বাবদ নেওয়া অর্থ ফেরত ও ফৌজদারি মামলাসহ সাত দফা শাস্তি কার্যকরের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে ৩৫ কোটি ৫৬ হাজার ১১৮ টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে যারা এমপিওভুক্ত নন তারা সরকারি কোনো বেতন-ভাতা না নেওয়ায় তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো সুপারিশ করা হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, যে ৬৭৮ শিক্ষকের সনদ জাল পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাল করা হয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের সনদ (এনটিআরসিএ)। ৫১২ জনই এনটিআরসিএর নিবন্ধনের ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন।
এছাড়া এসব শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার), রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সনদ জাল করে জমা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন।
আদেশে জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাত দফা শাস্তি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে এমপিও বন্ধ এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা, গ্রহণ করা বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া, ফৌজদারি অপরাধে মামলা করা, নিয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অবসরপ্রাপ্তদের অবসর সুবিধাপ্রাপ্তি বাতিল, স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়াদের অর্থ অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে আদায় এবং অবসর ভাতা/কল্যাণ ট্রাস্টের ভাতা বন্ধ।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর যাচাই-বাছাই করে ৬৭৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জাল সনদ শনাক্ত করেছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সনদ প্রদানকারী দপ্তরপ্রধান প্রতিনিধি সমন্বয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সনদের সত্যতা যাচাই করে জাল সনদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
শিক্ষকরা বলেছেন, যে সব শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাদের সনদ পরীক্ষা করা হয়। যে সংস্থা থেকে ঐ শিক্ষক সনদ পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থায় ঐ সনদ যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। সংস্থাগুলো যাচাই করে জাল নাকি সঠিক এর তথ্য পাঠায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে।
তবে তারা বলেন, যে সব শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদের অভিযোগ পাওয়া যায়, শুধু সেগুলো তদন্ত করা হয়। ফলে তদন্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছে বহু সনদ। ফলে এখনো কত শিক্ষক জাল সনদে চাকরি করছেন তার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এনটিআরসিএর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা যে সব শিক্ষকের সনদ যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন তার ৯০ ভাগই জাল।
শিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগে সব ধরনের শিক্ষক নিয়োগ গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে হতো। তখন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হতো। ফলে সনদ যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজনও বোধ করা হয় না। বর্তমানেও যখন নিয়োগ দেওয়া হয় তখন স্ব স্ব সংস্থার মাধ্যমে সনদ যাচাই করা হয় না। যাচাই করা হলে শুরুতেই জাল সনদধারীরা বাদ পড়ে যেত।
আরো পড়ুন : অডিও বার্তায় খাদিজা শাহ-আমি নিজেকে পুলিশের সোপর্দ করতে যাচ্ছি