নানা শঙ্কা নিয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচন, আজমত উল্লা খানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জায়েদা খাতুন

জনদুর্ভোগ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

বিশেষ প্রতিবেদক, গাজীপুর থেকে : আয়তনের দিক দিয়ে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুর। একদিন পরেই এ সিটিতে বসছে ভোটের আসর। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই তাদের কোনো প্রার্থীও নেই নির্বাচনে। এতে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়েছে নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লা খানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও ভোটের পরিবেশ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। সাধারণ ভোটাররা ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জায়েদা খাতুনকে ধরা হচ্ছে। তিনি টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন ইতিমধ্যে কয়েক দফা হামলার শিকার হয়েছেন।

তার প্রচার গাড়িতে হামলা করা হয়েছে। প্রচারে বাধা দেয়া হয়েছে। এসব কারণে স্থানীয় ভোটাররা অনেকে শঙ্কিত। তারা মনে করছেন ভোটের দিনও এমন পরিস্থিতি হতে পারে। তাই নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্টদের ভোটের দিন কঠোর অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সোমবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় নির্বাচনের আমেজ অন্যান্য নির্বাচনের মতো নেই। নেই ব্যানার- পোস্টারের আধিক্য। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ির পোস্টার চোখে পড়লেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার এলাকা টঙ্গীতে দেখা মেলেনি কোনো পোস্টার। রাজিয়া বেগম নামে এক চা দোকানি বলেন, বুঝেনই তো চায়ের দোকান। নানান রকম কথা শুনি। সারাদিনই পোস্টার দেয়। সন্ধ্যার পর নেতারা এসে বিল কাপের হিসাবে দেয়। এমনকি ১০০/২০০ টাকা বেশিও দেয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভোটের দিন দোকান খুলবো না। পাশের স্কুলে কেন্দ্র হবে। এখানে আমার দোকান। দোকান করেই দিন কাটাই। কখন কী বিপদ হয় কে জানে।
অটোচালক জয়নাল মিয়ার বাড়ি বাটা গেটের পেছনে। তিনি বলেন, চারপাশে নির্বাচনী প্রচারণা। মিছিল মিটিং হয়। ভয় হয় কখন কোথায় কী গ্যাঞ্জাম লাগে।

সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের এলাকা ডেগের চালাতে গিয়ে দেখা যায় তার মায়ের পোস্টারের আধিক্য। এই এলাকার এক মধ্যবয়স্ক বাসিন্দা বলেন, শুনেছি ভোটের আগের দিন আর ভোটের দিন আওয়ামী লীগের লোকজনের বেশি নজর থাকবে এই এলাকায়। জাহাঙ্গীর যদি শোডাউন করেন এই এলাকার লোকজনই থাকবে বেশি। সেজন্য একটা ভয় আছেই।
একই কথা বললেন, চা দোকানদার সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার দোকানে পোলাপান আড্ডা দেয়। তাগো মুখ থাইক্যা শুনছি, এই এলাকায় কিছু হইলেই মাইর দিবো তারা।
ওদিকে টঙ্গীর বাটা গেট, টঙ্গী স্টেশন এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বললে তারা অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এলাকা হওয়ায় এখানে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন তারা।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা আদনান আহমেদ বলেন, জায়েদা, জাহাঙ্গীরের গাড়িতে হামলার পর থেকে এলাকায় যারা টেবিল ঘড়ির প্রচারণা করেছে তারাও চুপ হয়ে গেছে। তবে নির্বাচনের দিন কী হয় বলা মুশকিল।

টঙ্গী স্টেশনের বিপরীতে ভেতরের গলিতে সাজিয়া গার্মেন্টসের নিরাপত্তাকর্মী নিরঞ্জন দাস বলেন, ভোটের দিন গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে কইছে মালিক। সেদিন গার্ডদের সবাইকে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত থাকতে বলছে। আমাদের দুটো গেটÑ বড় গেট বন্ধ করা হয় না বললেই চলে। সেদিন বন্ধ রাখবো।

টঙ্গী ইজতেমা মাঠের পাশে আখের রস বিক্রি করেন মো. আলিম। তিনি নির্বাচনের কথা তুলতেই বলেন, নির্বাচনের অবস্থা কি কমু। মুখ খুলতেও ভয় লাগে। এমন এক নির্বাচন চলতাছে কখন যে কি হয় বুঝতে পারছি না। এই শুনি টেবিল ঘড়ি জিতা যাইবো আবার শুনি নৌকা। মারামারিরও ভয় আছে। রাত হলেই গরম হয় এলাকা। এমন ভয় থাকলে ভোট দিতেই যামু না। জানের সঙ্গে কিছুর মায়া দয়া নাই। বাঁইচা থাকলে অনেক ভোট দিতে পারুম।

রোকসানা ফেরদৌস নামে এক স্কুল শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, মেয়ে পড়ে ক্লাস থ্রি তে। চলাফেরায় মনের মধ্যে ভয় কাজ করে। হঠাৎ মারামারি লেগে গেলে কিছু করারও থাকবে না। আজকেই শেষ। আর বের হবো না। নির্বাচনের পরে অবস্থা বুঝে বের হবো। আর প্রার্থীরা সবাই আসে, ভোট চায়। দোয়া চায়। দোয়া করি সবার জন্য। কিন্তু ভোট দেয়া হবে কিনা তা এখনো জানি না। সবার মধ্যেই একটা শঙ্কা কাজ করছে। অবস্থা বেগতিক হলে ভোট দেয়া পরের কথা বাসা থেকেই বের হবো না। শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা গাজীপুর। ভোটার প্রায় ১২ লাখ। সিটির ভেতর অধিকাংশ মানুষই এলাকার ভোটার নন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিফ খান বলেন, এবার আমার এবং আমরা যারা একসঙ্গে বড় হয়েছি- সবার প্রথম ভোট। আমরা চাই ভোট দিতে। তবে তিনি সন্দিহান তার ভোটের গুরুত্ব নিয়ে। বলেন, আমার এলাকায় নানা সমস্যা। আমরা অনেকেই বলি রাস্তাঘাটের কথা। নিরাপত্তার কথা। কিন্তু গাজীপুরে শিল্পাঞ্চল হয়ে যে খেলার মাঠ শূন্যের কোঠায় সেটা কেউ বলে না।

তার বন্ধু মো. সজল বলেন, এলাকায় সবাই নাকি মেয়রের লোক, সবাই কাউন্সিলরের লোক। আমরা স্থানীয়, আমাদের সঙ্গে সন্ত্রাসী কায়দায় চলাচল করে। আমরা চাই যেই নির্বাচিত হোক সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হোক।

গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় দেখা মেলে ভিন্ন চিত্র। এই প্রতিবেদক সেখানে যাবার কিছু সময় আগে আজমত উল্লা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। অনেকের হাতেই লিফলেট। তীব্র গরমে মোড়ে লাচ্ছি বিক্রি করছিলেন একজন। তা পান করতে করতে চলছে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। জানতে চাইলে সবুজ আহমেদ বলেন, ভোট দেবো কিনা জানি না। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ ভোট দিতে গিয়ে কী রকম অবস্থা হয়। তবে আমার মা বারবার বলছে, মরার আগে এটাই হয়তো তার শেষ ভোটÑ সে দিতে যেতে চায়।

মোড়ে লিফলেট বিতরণ করছিলেন বিউটি আক্তার নামে এক নারী। তিনি বেশ কিছুদিন এনজিও’র সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, এনজিওতে কাজ করায় দৌড়াদৌড়ির অভ্যাস আছে। এরপর আসলো নির্বাচন। কাউন্সিলরের হয়ে লিফলেট দিচ্ছি। কয় ঘণ্টা এভাবে লিফলেট দেন এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের সময় ও জায়গা ভাগ করা। একেকদিন একেক জায়গায় যাই। বাসাবাড়িতে তো বেশি ঢুকতে দেয় না। বাইরে দোকানপাটে, রাস্তায়, স্কুলের সামনে অভিভাবকদের লিফলেট দেই। ঘণ্টা হিসেবে আমাদের টাকা দেয়া হয়। ডিউটিও ভাগ করা। সকাল ৮টায় বের হলে ২টা পর্যন্ত কাজ করি। আবার ১২টায় বের হলে ৫টা। দিনপ্রতি টাকা দেয় ৩০০ থেকে ৫০০। আবার অনেক ৫০০- ৮০০ টাকাও পায়। অল্পবয়সী ছেলেরাও লিফলেট দেয়। ওদের ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দেয়। আমার টাকার দরকার। এ জন্য কাজ করছি।

বোর্ড বাজার এলাকার স্কুল শিক্ষক এখলাছ উদ্দিন বলেন, দেশের সমসাময়িক সময়ে নির্বাচন হওয়াটা খুব জরুরি। আমি চাইÑ একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হোক। কোনো ধরনের হামলা, সংঘর্ষ ও দুর্নীতি ছাড়া একটি নির্বাচন হোক।

নির্বাচনে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছাড়া মেয়র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন (লাঙল), জাকের পার্টির রাজু আহমেদ (গোলাপ ফুল), হারুন অর রশিদ (ঘোড়া), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান (হাতপাখা)।

আরো পড়ুন : চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম, সবচেয়ে বড় চোর হলো মশিউজ্জামান

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *