স্টাফ রিপোর্টার : দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে রাজধানীর গুলিস্তান হোটেল ইম্পেরিয়ালের মিলনায়তনে ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ এবং একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়’- শীর্ষক মতবিনিময় সভায় জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেন দলটির আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।
মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগ ছাড়া নিবন্ধিত অধিকাংশ দলকে আমন্ত্রণ জানায় ইসলামী আন্দোলন। বিএনপি’র পক্ষে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতুল্লাহ বুলু ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সভায় যোগ দেন। জাতীয় পার্টির কেউ সভায় আসেননি। তবে, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ উপস্থিত ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীকে দলীয়ভাবে আমন্ত্রণ জানানো না হলেও দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য খলিলুর রহমান মাদানীকে দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি মতবিনিময় সভায় এসেছিলেন। সভায় অংশ নেয়া ১৫টি রাজনৈতিক দলের বক্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সবাই একত্মতা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ জাতীয় সরকারের অধীনে হতে হবে।
ঘোষিত জাতীয় সরকারের প্রস্তাবিত রূপরেখায় বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের একজন বিজ্ঞ, সৎ, যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য বিচারপতিকে প্রধান করে নিবন্ধিত দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন হবে। যারা জাতীয় সরকারে থাকবেন, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।
জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সংসদ ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। জাতীয় সরকার পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। বর্তমান মন্ত্রিসভার কেউই নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে থাকতে পারবেন না।
লিখিত বক্তব্যে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, সব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাচনটি সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ভোটের নামে প্রহসন করে, ভোটকেন্দ্র দখল করে দিনের ভোট রাতে নিয়ে এবং ইভিএম’র মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপি করে গোটা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে লজ্জিত করেছে। এতে করে ক্ষমতাসীন সরকার জনবিচ্ছিন্ন একটি স্বৈর সরকারে পরিণত হয়েছে। সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম আরও বলেন, সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজন করার পাঁয়তারা করছে এবং মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমরা আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি-দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে না।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান বরকতুল্লাহ বুলু বলেন, ইসলামি আন্দোলনকে ধন্যবাদ যে তারা জাতির সামনে এমন একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছেন। আপনারা বলেছেন, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না, এই সরকারের পতন ছাড়া আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন না। এজন্য সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে আমি বিএনপি’র পক্ষ থেকে আপনাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানায়। তিনি আরও বলেন, দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। আন্দোলন করে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আমরা এককভাবে ক্ষমতায় যেতে চায় না। বিএনপি’র রূপরেখায় এটি বলা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে যারা থাকবেন তাদেরকে নিয়েই একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। সরকার এটাকে ষড়যন্ত্র বলছে। যদি এই দাবিকে ষড়যন্ত্র বলা হয় তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি ৯৫ সালে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে, জনগণের প্রয়োজনে, তাদের অধিকার আদায়ে সংবিধান পরিবর্তন করা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘জাতীয় সরকারের প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ এই বিশ্বাস একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। যে যেভাবে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের কারণেই কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু মানুষ গরুর দুধ পানিতে ফেলে দিয়ে গঙ্গাকে পবিত্র করে। আর গরুর মুত খেয়ে তারা আনন্দ পায়। এর মূলে কিন্তু রয়েছে বিশ্বাস। তিনি বলেন, আপনারা সিইসি’র পদত্যাগ দাবি করেছেন। কিন্তু শুধু সিইসি’র পদত্যাগ দাবি করলে মনে হয় যে চরমোনাই পীর সাহেব আহত হয়েছেন এই ক্ষোভে তিনি শুধু উনার পদত্যাগ দাবি করেছেন। পুরো ইসি’র পদত্যাগ দাবি করলে ভালো হয়। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের মতো রক্তপিপাসু মানুষের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। ৭০ সালের নির্বাচনে মানুষ মুক্তির আশায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। সেই নির্বাচনগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক নাই। তাহলে পাকিস্তান কি নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার চেয়েও ভালো ছিল? এই প্রশ্ন যদি পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের করে, তাহলে উত্তরটা কি? যদি উত্তরটা হ্যাঁ হয়, তাহলে আমি হবো রাজাকার। আর যদি না বলি তাহলে আমি হবো মুক্তিযোদ্ধা। কোন দিকে যাবো বলেন। বিএনপি’র এই নেতা বলেন, বাংলাদেশে ভোট কারচুপি, গুম, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্রস ফায়ার ইত্যাদি সবদিক থেকে প্রথম স্থান অধিকার করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ৭৩ সালের নির্বাচনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম ব্যালট বাক্স ছিনতাই শুরু করেছিল। তখন থেকেই এই কালচার শুরু হয়। এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানান।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সব ধরনের তদবির করছে। কারণ, ভারতের চাওয়ার আগে হাসিনা সরকার সবকিছু দিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, অন্যরা ক্ষমতায় এলে সেন্টমার্টিন, গ্যাস বিক্রি করে দেবে। শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে বলতে চায়, আপনি কিসের বিনিময়ে ভারতকে সব দিয়ে দিয়েছেন। আপনিই তো বিক্রি করে দিয়েছেন। আজকে সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে আপনি ক্ষমতায় আছেন। তিনি বলেন, এদেশের জনগণ যদি রুখে দাঁড়ায়, আন্দোলন শুরু করে তাহলে এই সরকার পালাবার জায়গা পাবে না। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। জাতীয় সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আপনাকে বিদায় করবে। কেউ জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আপনি শেখ হাসিনাও জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। আমি এই সরকারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী মজলিশে শূরার সদস্য ড. খলিলুর রহমান মাদানী, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, মুসলিম লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুল ইসলাম, এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশ জমিয়তুল মুছলেহীন এর আমীর মাওলানা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের, সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, খেলাফতে রব্বানী পার্টির চেয়ারম্যান মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আবদুল লতিফ মাসুমসহ ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য আল্লামা নুরুল হুদা ফয়েজী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, খন্দকার গোলাম মাওলা উপস্থিত ছিলেন।
আরো পড়ুন : পুতিনের বিরুদ্ধে লড়াই করা কে এই ইয়েভজেনি প্রিগোজিন!