অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ- মোটাদাগে এই ৩ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশে সত্যিকারের একটি নির্বাচন আয়োজনের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছেন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দল। ঘরোয়া এবং প্রকাশ্য আলোচনায় তারা অভিন্ন বার্তা দিয়েছেন। এতদিন ধরে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ওপর চোখ রাখা বহুল আলোচিত এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ওই মিশনে ছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, উজরা জেয়া এবং ডোনাল্ড লু এমন নির্বাচন দেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে গেছেন যাতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু সেই নির্বাচনটি কোন ফর্মে হবে অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকারের স্ট্রিয়ারিং কার হাতে থাকলে এটি দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা ঠিক করার ভার একান্তভাবেই বাংলাদেশের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
অর্থাৎ সরকার, নাগরিক সমাজ তথা বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিজ বৈঠক করে বাংলাদেশের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েই তারা বিমানে উঠেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটাই ডিপ্লোম্যাসি। বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তারা পরামর্শটি দিয়ে গেছেন। বাকিটা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের ‘পরিপক্ক’ রাজনীতিবিদদের। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তিতে এখন পর্যন্ত হোমগ্রোন সলিউশন চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সংলাপের উন্মুক্ত আহ্বান রেখেছে।
পারসেপশন বা জনমনের উপলব্দি যাই হোক না, যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো কিছুই চাপিয়ে দিতে চায় না তা প্রতিনিধি দল খোলাসা করে গেছে। উজরা-লু’র সফরকালে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নজিরবিহীন শান্তিপূর্ণ পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দেখেছে দুনিয়া।
এটি মার্কিন প্রতিনিধি দলেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ঢাকাবাসী এমন দৃশ্য খুব কমই দেখেছে, অন্তত গত ১৪ বছরে তো নয়ই। চিত্রটি ছিল এমন- এক সমাবেশে বণ্টন করা খাবারের প্যাকেট হাতে অন্য সমাবেশে ঢু মারছিলেন উৎসুক কর্মীরা।
অভ্যন্তরীণ হাঙ্গামা বা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকলেও সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়নি, যা বিদেশি অতিথিসহ সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। এবারে বিরোধী দলের সমাবেশকে ঘিরে পুলিশের অতিউৎসাহীদের কোনো চোটপাটও ছিল না। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন নাটকীয় পরিবর্তনের নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে সদ্য ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি।
প্রতিনিধি দল তাদের সফরে ভিসা নীতি নিয়েও কথা বলেছে। যে বা যারা ভোটে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরজা বন্ধ, এটি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে সব পক্ষের সহিংসতা প্রত্যাখ্যান এবং সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহিংসতা পরিত্যাগ তথা সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকা ছাড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হানিমুন ভেঙে গেছে! কুমিল্লায় বিএনপির গাড়ি বহরে হামলা হয়েছে এবং তাতে ৬০ জন আহত হয়েছেন।
মার্কিন প্রতিনিধি দল একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ এবং ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গেছে। তারা এমন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির তাগিদ দিয়েছে যাতে বাংলাদেশের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের মতামত তথা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিচ্ছে না এমনটা স্পষ্ট করে প্রতিনিধি দলের তরফে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একটাই চাওয়া তা হলো বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। এমন নির্বাচন নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে জানিয়ে আগামীতে যা যা করা সম্ভব সব করার কথা জানিয়ে গেছে মার্কিন প্রতিনিধি দল।
সফরের সমাপনী দিন বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া প্রকাশ্যেই এ ঘোষণা দেন। বলেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যাতে ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে’ হতে পারে, সেজন্য যতটা ভূমিকা রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র তা রাখবে।
নির্বাচনের পরিবেশ বিষয়ে তিনি বলেন আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ‘দৃঢ় অঙ্গীকারের’ কথা শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা সব সময় অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। বাংলাদেশেও সেটা যাতে সম্ভব হয়, সেজন্য দীর্ঘমেয়াদী অংশীদার হিসেবে আমাদের সহায়ক ভূমিকাটা রাখতে চাই। সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ক্লোজডোর বৈঠকে ভোটের পরিবেশ নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার কথা জানান।
সুশীল সমাজ, মানবাধিকার রক্ষক, সাংবাদিক এবং শ্রমিককর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীতার কথা বলেন তিনি। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে সফরের বিস্তারিত জানিয়েছেন প্রতিনিধি দলের নেতা উজরা। সেখানে তিনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও কথা বলেছেন।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রশ্নে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো টাইমফ্রেম না দিলেও র্যাবের জবাবদিহিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক এবং অর্থবহ সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। সার্বিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার পথ অবারিত রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি দল। কাছাকাছি ভেন্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠানে সন্তোষ প্রকাশ করেন ও পরবর্তীতেও এমন সহনশীল চিত্র দেখার আকাঙঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। সর্বত্র মুক্তভাবে মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
শক্তিশালী গণতন্ত্র এবং ভোটে সবার অংশগ্রহণের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি নির্ভর করছে জানিয়ে প্রতিনিধি দলের তরফে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে বলা হয়, সাংবাদিকদের ভীতি, প্রতিশোধ ও ভয়ভীতিহীনভাবে সংবাদ পরিবেশনে সক্ষম হতে হবে।
গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজের কথা বলার জায়গা থাকতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে গত মে মাসে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিরা মার্কিন ভিসা পাবে না। অর্থাৎ তাদের দীর্ঘমেয়াদি ভিসা থাকলেও তা বাতিল করা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণার পর দেশটির উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি দলের এটাই ছিল প্রথম ঢাকা সফর।
নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় আসা মার্কিন প্রতিনিধি দলটি উল্লেখযোগ্য সময় কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা শিবিরে কাটিয়েছে। প্রতিনিধি দলের প্রধান উজরা বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে গেলেও ওই টিমের প্রভাবশালী সদস্য ডেনাল্ড লু এখনো দক্ষিণ এশিয়াতেই রয়েছেন। শুক্রবার পৃথক ফ্লাইটে তিনি কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যান।
সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করুন- রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রতিনিধি দল: এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া।
বলেন, সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য আমি সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। একাধিক সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া বলেন, আসুন আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দেই। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে একযোগে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন বলে জানান জেয়া। সেন্টমার্টিন দ্বীপ চায় যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ সরকারের এমন বক্তব্য বিষয়ে মার্কিন ওই কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের সম্ভাব্য ইজারা নিয়ে আলোচনার দাবি নাকচ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ বাড়াচ্ছে এমন ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে জেয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতেই তার সফর। তিনি বলেন, আমরা অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করতে চাই। আমরা মনে করি, এই অংশীদারিত্ব অভিন্ন গণতান্ত্রিক নীতি এবং মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-মার্কিন অংশীদারিত্বের দীর্ঘায়ু ও বিস্তৃতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেকেই হয়তো জানেন না যে, সমগ্র এশিয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণী উন্নয়ন অংশীদার।
কক্সবাজারে ‘অত্যন্ত মর্মস্পর্শী’ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। কক্সবাজারের জনগণকে সমর্থনকারী ব্যক্তিরা আমাদের বৈঠকে ছিলেন। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ যে অসাধারণ উদারতা দেখিয়েছে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কৃতজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে সেই প্রত্যাবসন নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, মিয়ানমারে এখানো সেই পরিস্থিতি নেই। রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রত্যাবাসন না করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছ প্রতিশ্রুতি পেয়ে আনন্দিত বলেও জানান তিনি। ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরো পড়ুন : জেনে নিন কোন ৬ উপায়ে রাতে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়