আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লি. কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ আর শফিকুল ইসলাম (৫৭)। গাজীপুর টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকার মাদ্রাসা রোডের বনমালা গ্রামে তার বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণকাজ দেখাশোনার জন্য গত ৭ই আগস্ট সকালে তিনি বনানীর বাসা থেকে রওয়ানা হন। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও তার কোনো খবর পাচ্ছিলেন না স্ত্রী খালেদা বেগম। এমন সময় দেবর মোর্শেদ আলম ফোন দিয়ে জানান শফিকুল গাজীপুর থেকে আসার সময় অজ্ঞান পার্টি চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। বাসে এসে মহাখালী নামার পর তার অবস্থা গুরুতর হওয়াতে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন বাসের স্টাফ ও অন্যরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিকুল হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন। শুধু শফিকুল না ওই বাসে থাকা আরেক যাত্রী আরিফুল ইসলাম আরমান (৪৩) অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন। যদিও চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে যান। এ ঘটনার পরে শফিকুলের স্ত্রী খালেদা বেগম বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন।
ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে পারেন। ওইদিন ওই বাসে শফিকুল ও আরমানকে হারবাল ওষুধের কথা বলে হালুয়া রুটির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব নিয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে অজ্ঞানপার্টির প্রাণঘাতী হালুয়া যেন নয়া আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে লোকাল ও দূরপাল্লার বাসে যারা চলাফেরা করেন তাদেরকে প্রায়ই হারবাল ওষুধের আড়ালে চেতনানাশক দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে মৃত্যুরমুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কারণ প্রাণঘাতী এসব চেতনানাশক যাদেরকে খাওয়ানো হচ্ছে তাদের শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে না পারলে বাঁচার আশা কমে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তারা খুব সুকৌশলে এটি বাস্তবায়ন করে। হকার সেজে বাসে উঠে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে তারা মানুষকে চেতনানাশক দ্রব্য খাইয়ে দেয়। প্রতিটা বাসে চক্রের একাধিক সদস্য আগে থেকে যাত্রী হিসেবে বসে থাকে। হকার সেজে চক্রের সদস্য বাসে উঠে পণ্যের বিজ্ঞাপন করার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে বসে থাকা চক্রের সদস্যরা এসব পণ্য কিনে নেয়। এতে করে অন্য যাত্রীরা উদ্বুদ্ধ হয়ে পণ্য কিনে। কিন্তু চেতনানাশক পণ্য শুধু টার্গেট যাত্রীদের কাছেই বিক্রি করা হয়।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, ঢাকার সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়া রোগীরা আসেন। যারা আসেন তাদের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। অনেকের চেতনা ফিরতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। আবার অনেকের চেতনা না ফিরে মৃত্যুবরণও করেন। অনেক রোগীর চেতনা না থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলাও যায় না। নাম ঠিকানা না জানায় অজ্ঞাত হিসেবে ভর্তি করা হয়। তাদের স্বজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায় না। কারণ তাদের সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা নিয়ে যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে যেসব রোগী আসছেন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সুস্থ হওয়ার পরে কথা বলে জানা যায় তারা প্রত্যেকেই বাস, বাস-টার্মিনাল বা ভ্রমণ করতে গিয়ে হারবাল হালুয়া খেয়ে খপ্পরে পড়েন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যরা এখন নতুন কৌশলে কাজ করছে। বিভিন্ন চক্র এখন হকার সেজে হারবাল ওষুধ বিক্রি করার নামে গণপরিবহনে উঠে মানুষকে চেতনানাশক খাইয়ে দিচ্ছে। অসচেতন যাত্রীরা চক্রের সদস্যদের নানা কৌশলের কাছে হেরে এসব হারবাল হালুয়া খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে চক্রের সদস্যরা তাদের সর্বস্থ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। একেকটি বাসে তাদের একাধিক সদস্য অবস্থান করে। তারাও যাত্রীদের সঙ্গে যাত্রী হিসেবেই কথা বলে। চেতনানাশক খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। তবে এসব চক্রের একাধিক সদস্য পুলিশ ও ডিবি’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনে বের হয়ে আবার তারা একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।
নিহত শফিকুল ইসলামের স্ত্রী খালেদা বেগম মামলার এজাহারে বলেছেন, তার স্বামী রাজীব পরিবহনের গাড়িতে করে উত্তরা জসিম উদ্দিন রোডের মোড় থেকে বনানীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে পথে অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন অজ্ঞানপার্টির সদস্য ওই গাড়ির ভেতরে শফিকুলকে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানোর কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ওই বাসের চালকসহ অন্যরা তার স্বামীকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
শফিকুলের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যে দুই জনকে ডিবি তেজগাঁও বিভাগ গ্রেপ্তার করেছে তারা হলো- মো. মানিক (৪২) ও মোজাম্মেল হক মোজা (৫৬)। মানিককে রোববার টঙ্গি পশ্চিম থানা এলাকা ও মোজাকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুজনই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা আছে বলে দায় স্বীকার করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজীব পরিবহনের বাসটি জামালপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে টঙ্গী চেরাগ আলী থেকে ভুক্তভোগী শফিকুল ও আরিফুল ওঠেন। এরপর বাসটি উত্তরা আজমপুর আসলে একজন যাত্রী নামার পরে ৪/৫ জন যাত্রী ওঠে। এ সময় মডার্ন হারবাল নামীয় যৌনবর্ধক হালুয়া এবং ব্রোশিয়া নামের ভিটামিন ওষুধ যাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করেন হকারের বেশধারী অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা। বাসের পেছনের সিটে বসা শফিকুল ও আরিফুলকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে তৈরি হালুয়া খাওয়ানোর পর তারা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বাসটি বনানী পৌঁছালে গুলশান ১১ নম্বর রোডের মাথায় পুলিশ বক্সের সামনে বাস থেকে মানিক, মোজাম্মেলসহ ৩/৪ জন যাত্রী একসঙ্গে নেমে যান।
ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, চক্রটি শফিকুলের কাছে থাকা মানিব্যাগ, বাড়ি বানানোর টাকা ও আরিফুলের কাছে থাকা ১০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এটি একটি ক্লুলেস ঘটনা ছিল। ঘটনার দিন চক্রের আরও অনেকেই ছিল। দুজনকে গ্রেপ্তার করেছি বাকিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, যাত্রীদের সচেতনতা দরকার। অপরিচিত ব্যক্তিদের দেয়া কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। না হলে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের থামানো যাবে না। আমাদের নজরদারি আছে। প্রায়ই তাদেরকে গ্রেপ্তার করি। এ ছাড়া বাসের চালক ও হেলপারদেরও এসব বিষয়ে ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরো পড়ুন : কামরাঙ্গীরচর ও বাড্ডায় দুই তরুণের অস্বাভাবিক মৃত্যু