স্টাফ রিপোর্টার : গণতন্ত্র না থাকলে মুক্ত সাংবাদিকতা আশা করা যায় না। মুক্ত সাংবাদিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে- মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এ দু’টিই এখন অনুপস্থিত। সরকার নানাভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যেসব গণমাধ্যম নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করছে, তাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না।
গতকাল ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাক্সক্ষা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ভয়েস বাংলার সম্পাদক মোস্তফা ফিরোজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর আ-আল মামুন, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো ড. সাইমুম পারভেজ। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল।
ওয়েবিনারে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ভয়ের সংস্কৃতিতে থেকে সাংবাদিকরা মুক্তভাবে লিখবেন এটা কী করে আশা করা যায়? মুক্ত সাংবাদিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এ দুটিই এখন অনুপস্থিত। তিনি বলেন, আমরা সাংবাদিকরা অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছি।
এটা হওয়ার কথা ছিল না। বর্তমানে তারা গণমাধ্যম বন্ধ না করে বরং বেশিসংখ্যক পত্রিকা-টেলিভিশনের অনুমোদন দিয়ে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ নিয়ন্ত্রণ কতোদিন চলবে জানি না। এ নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে না পারলে কোনোদিনই মুক্ত সাংবাদিকতা আশা করা যায় না। সংবিধান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলছে। অবাধ নির্বাচন কিন্তু সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।
এ সময় সম্প্রতি রাশিয়ার এক শীর্ষ কর্মকর্তার বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ খবরটা ঢাকার কোনো মিডিয়া পায়নি। পেয়েছে স্যোশাল মিডিয়া। খবরটি গোপন করা হয়েছে। এমন কেন হচ্ছে? আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে আমি আশঙ্কিত। আমার মনে হয় কোথায় যেন একটা গোলমাল হতে যাচ্ছে। আমরাও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো হয়তো সংকটের দিকে যাবো।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা কীভাবে চলছে সেটা সবাই জানেন। সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ চলছে। এর বাইরে কেউ নেই। একটা অবাধ নির্বাচনের জন্য মিডিয়ার ভূমিকা আছে। কিন্তু মিডিয়াতো বিভক্ত। শুধু বিভক্ত না একপেশে। এখন আবার মিডিয়াতে সেল্পসেন্সরশিপ বেড়ে গেছে। রিপোর্টার নিজেও এক ধরনের সেন্সরশিপের মধ্যে চলে গেছেন। এ থেকে বের হওয়া দরকার। আমরা সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছি। কিন্তু একটা সংসদ বহাল রেখে আরেকটা সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয় কীভাবে? তিনি বলেন, আইনের শাসন ও শাসনের আইন নিয়ে এ দেশের মানুষ হতাশ, কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। তবে হতাশার মধ্যেও আশা আছে। সময় একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন। কারণ একদিন আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। আশা নিয়েই রাষ্ট্র্র, সমাজ, জাতি। সবকিছু একদম শেষ হয়ে যাবে না। আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু একদিন পরিবর্তন হবে।
মূল প্রবন্ধে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, দেশের মানুষের চিন্তা হলো- ভোটটা ঠিকঠাকভাবে দিতে পারবে কিনা? মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাক্সক্ষা প্রবল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং অনেক সময়ই গণমাধ্যমগুলো শাসকগোষ্ঠীর সহযোগীর ভূমিকায় থাকছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র যে ধারা জনগণের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছে, তাদের আরও প্রবল ও বেগবান করা এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিকীকরণ এতটাই সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে যে গণমাধ্যমগুলোও এখন আওয়ামীপন্থি বা বিএনপিপন্থি ট্যাগযুক্ত হয়ে গেছে। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম যা কিছুই বলুক না কেন, তা সাধারণ মানুষের মনে তেমন আস্থার জন্ম দিতে পারছে না। মূলধারার গণমাধ্যম মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এই সুযোগে অনেক সুবিধাবাদী বা ক্ষতিকর লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণহীন অপপ্রচার চালাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে তারা মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার বিচিত্র কিছু পদ্ধতিতে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো-সরকারি বিজ্ঞাপন। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন গণমাধ্যমের প্রভাব অনেক কমে গেছে। বাসায় পত্রিকা রাখার প্রবণতা, রাতে গুরুত্ব দিয়ে টেলিভিশন সংবাদ দেখার অভ্যাস কমে গেছে। গণমাধ্যমগুলো এখন আর গণঅধিকারের কথা বলে না, গণপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটায় না। বরং তারা বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির জন্য কাজ করে। বিনিময়ে তারা সরকার বা ক্ষমতাসীনদের গুণগানে ব্যস্ত থাকে।
এ সময় ভয়েস বাংলার সম্পাদক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, গণমাধ্যমে এখন বিরুদ্ধমতের সাংবাদিকের চাকরি থাকে না। গণমাধ্যম তার কণ্ঠ সোচ্চার করতে পারছে না। দু-একটি পত্রিকা চেষ্টা করলেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবসে একটি সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে অন্যান্য গণমাধ্যম সরকারের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। এগুলো থেকে মুক্ত হতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। তিনি বলেন, ওয়ান ইলাভেনের থেকেও এখন বেশি করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কোনো কোনো মিডিয়া এমনভাবে ব্যবহার হচ্ছে যে তাতে অন্যগুলোকে শরিক করার চেষ্টা করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর আ-আল মামুন বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার কোনো রেকর্ড আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রিসেন্ট হিস্ট্রি অন্তত আমাদের তা-ই বলে। যারা ক্ষমতায় থেকেছেন তারা সবসময় নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন। আগে মিডিয়াগুলো পাবলিক ওপেনিয়ন ফর্ম করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা নিতো, সেটি এখন দেখছি না।
তিনি বলেন, মিডিয়া জানে কেন সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু তারা সে রোল প্লে করছে না। নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ মতামত প্রকাশের সুযোগ, ভীতিহীন পরিবেশ তৈরি করা। এ দায়িত্বটা পড়ে মিডিয়ার ওপর। ভয়ভীতিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করতে ওয়াচ ডগের ভূমিকা রাখবে। মিডিয়া যখন তার ক্লাসিক্যাল অবস্থান থেকে সরে এসেছে তখনই নানা ধরনের ইন্টারেস্ট তৈরি হচ্ছে। পাবলিক ওপেনিয়ন ফর্ম করার ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়াগুলো যাচাই-বাচাই না করে বিদেশি সোর্স ব্যবহার করে মিথ্যাচারের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সমাপনী বক্তব্যে ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো ড. সাইমুম পারভেজ বলেন, একটি দেশের গণমাধ্যম কোন অবস্থায় থাকবে তা নির্ভর করে দেশটির সরকার ব্যবস্থার উপর। সাংবাদিকদের ভূমিকা, জনগণের ভূমিকা, সুশীল সমাজের ভূমিকা সবই সরকারের কাঠামোর উপর নির্ভর করে। স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মূল সমস্যা এমন একটি সরকারের অনুপস্থিতি যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের উপস্থিতি। বিভিন্ন সরকারের সময় সাংবাদিক নিপীড়নের কথা বলা হলেও গবেষণা বলছে, বর্তমান সরকারের আমলে সাংবাদিকরা নানান ডাইমেনশনে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। এটি উপলব্ধি করে সাংবাদিকদের উচিত কোন সিস্টেমে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো যায় তা নিয়ে ভাবা, কথা বলা।
আরো পড়ুন : শিশুরা বেশি ভুগছে ডেঙ্গুতে