দেশব্যাপী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুতে শুধু বড়রাই নন, আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও। বিশেষ করে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গুতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানের প্রায় ২৫ ভাগ শিশু। আক্রান্তের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ২১ শতাংশ শিশু। দেখা যাচ্ছে, শিশুরা চিকিৎসার আওতায় আসছে দেরিতে। স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করা হচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে। তাই এই সময়ে অভিভাবকদের ডেঙ্গু নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন থাকা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
শিশুদের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় দ্রুত জটিল হয়ে পড়ছে শারীরিক অবস্থা। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থা হাসপাতালে।
দিনরাত মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রাতে তো বটেই, দিনের বেলা যেকোনো সময় ঘুমালে শিশুকে অবশ্যই মশারির ভেতর রাখতে হবে। অন্যান্য সময় শরীর খালি অংশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। সাদা বা কম উজ্জ্বল কাপড়ের প্রতি মশা আকৃষ্ট হয় কম। তাই বাচ্চাদের উজ্জ্বল রঙের কাপড় কম পরানো উচিত।
শিশুর মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শিশুরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বুঝতে বা বলতে পারেনা। শরীরে রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে শুরু করে। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর শকে চলে যায়। যদি প্রথম দিকে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সমস্যা হয় না। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার আওতায় আসতে দেরি হলে শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। ওই সময় জরুরি চিকিৎসা করলেও বাঁচানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বাচ্চারা দিনে বা রাতে যখনই ঘুমাবে অবশ্যই মশারি টাঙাতে হবে। বাচ্চারা ঘুমানোর সময় যাতে শরীরের কোনো অংশ খালি না থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। যাদের চলাফেরা কম, তাদের মশায় কামড়ানোর হার অনেক বেশি। বিশেষ করে যেসব শিশু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে বা দিনের বেলায়ও ঘুমায়, তাদের মশারির নিচে থাকার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর বড় কিংবা ছোট যেকোনো বয়সের মানুষের জ্বর দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শও দেন তিনি। শিশুদের রোগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে তাদের ঝুঁকি বেশি। শিশুরা দিনের বেলা ঘুমায়, আর এডিস মশাও দিনের বেলায় কামড়ায়। বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে তাদের জন্য ফুল-লেংথ ট্রাউজার এবং ফুল-হাতা কাপড় পরানো উচিত।
পুরান ঢাকা হাজারীবাগের বাসিন্দা সাজ্জাদের মা বলেন, গত তিনদিন ধরে তার শিশুটি ডেঙ্গু জ¦রে ভুগছে। আমাদের বাসার কোথাও মশা নেই। তারপরও কোথা থেকে যে বাচ্চাটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো বুঝতে পারছি না। তিনি জানান, তাদের বাসায় মশারি কম টাঙানো হয়। মনে হচ্ছে আশপাশের কোথাও থেকে মশায় তাকে কামড় দিয়েছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই বছর বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু। হাসপাতালটির এক শিশু চিকিৎসক বলেন, একাধিক রোগী এক বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছেন আবার কেউ ফ্লোরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এক বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। জ্বর থাকলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত; এটাকে ভাইরাল জ্বর বলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বর চলে গেলে ভয় শুরু হয়, তখন আপনাকে আরও সতর্ক হতে হবে। ছোট শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা কঠিন কারণ তাদের রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপা যায় না। শিশুদের দেহে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টও চ্যালেঞ্জিং। শিশুরা তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে না এবং যে কোনো সময় শকে চলে যেতে পারে। এজন্য আপনাকে শিশুদের ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
শিশুদের ডেঙ্গু ঝুঁকি বেশি কেন: কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, শিশুদের আক্রান্তের সঠিক কারণ জানতে পারলে এর প্রতিকার করা সম্ভব। কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি শিশুদের মশা কামড়ানোর ঝুঁকি বেশি। স্ত্রী মশার পেটে যখন ডিম আসে তখন তার প্রধান খাদ্য রক্ত এবং শিশুরা প্রায়শই এই মশার শিকার হয়। মশা কামড়ালে, শিশুর ত্বকে কামড় সঙ্গে সঙ্গে দেখা নাও যেতে পারে, তবে কিছুক্ষণ পরে বা কয়েক ঘণ্টা পরেও কামড়ের চুলকানি এবং ফোলাভাব হয়। তিনি বলেন. বাচ্চাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্রুত বিপাক হয়, বেশি নড়াচড়া এবং দৌড়াদৌড়ি করার কারণে ব্যায়াম হয় এবং তাপমাত্রা বেড়ে ঘাম হয় ও দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। মশা কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে শিশুদের কামড়াতে যায়। শিশুরা বেশি নড়াচড়া করার কারণে মশার জন্য আরও দৃশ্যমান এবং আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এই বিশেষজ্ঞ আরও জানান, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের ত্বকের তুলনায় শিশুদের ত্বক নরম এবং কামড়ের জন্য বেশি সংবেদনশীল। নরম ত্বকে সহজেই মশা তার হুল ফুটিয়ে রক্ত গ্রহণ করতে পারে। শিশুরা মশার কামড়কে সহজে বুঝতে পারে না এবং মশা তাড়াতে পারে না। ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি। দেখা যাচ্ছে, শিশুরা চিকিৎসার আওতায় আসছে দেরিতে। স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করা হচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে। তাই এই সময়ে অভিভাবকদের ডেঙ্গু নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন থাকা উচিত। অভিভাবকরা অবহেলা করলে চলবে না। শিশুর মৃত্যুর হারে দেখা যাচ্ছে, চারজনের মধ্যে তিনজনই ভর্তির দু’-এক দিনের মধ্যে মারা যায়।
শিশুর মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, শিশুরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বুঝতে বা বলতে পারেন। শরীরে রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে শুরু করে। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর শকে চলে যায়। যদি প্রথম দিকে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সমস্যা হয় না। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার আওতায় আসতে দেরি হলে শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। ওই সময় জরুরি চিকিৎসা করলেও বাঁচানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। খেলাধুলার সময়, স্কুলে বা বাসায় থাকা অবস্থায় যতটুকু সম্ভব লম্বা জামা কাপড় পরানো, যাতে মশা কামড়ানোর ঝুঁকি কম থাকে। সাদা বা কম উজ্জ্বল কাপড়ের প্রতি মশা আকৃষ্ট হয় কম। তাই বাচ্চাদের উজ্জ্বল রঙের কাপড় কম পরানো উচিত। পরিবারের কোনো সদস্য ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে অবশ্যই মশারির নিচে রাখতে হবে যাতে পরিবারের অন্য কেউ তার মাধ্যমে আক্রান্ত না হয়। নিয়মিত বাচ্চাদের নখ কাটুন যাতে মশা কামড়ালে শক্ত করে আঁচড়াতে না পারে। যদি শিশুর ডেঙ্গু জ্বর বা মশার কামড়ের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য রোগের সন্দেহ হয়, তাহলে শিশুর অবস্থা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য অভিভাবকদের শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে তিনি পরামর্শ দেন।
আরো পড়ুন: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না