স্টাফ রিপোর্টার: সাবেক স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হারুন-অর রশিদের রাগ-ক্ষোভ ছিল স্ত্রী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুনের ওপর। সেই ক্ষোভ থেকেই মাসুমা খাতুনকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন তিনি। পরিকল্পনায় ব্যবহার করা হয় ভুক্তভোগী মাসুমার সাবেক ড্রাইভার মাসুদকে। মাসুদের নেতৃত্বে অপহরণ মিশনে অংশ নেন মোট সাতজন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক স্বামী হারুন কর্তৃক হাতিরঝিলে ৫০ হাজার টাকায় একটি বাসা কন্টাক্ট করা হয়। তবে সে অহপরণের রাতে ওই বাসায় নেয়া সম্ভব না হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি গ্যারেজে নেয়া হয়। সেখানে গাড়িতেই ওই নারী কর কর্মকর্তাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। পরদিন মাদারটেক এলাকায় যাওয়ার পর সেখানে ওই নারী কর্মকর্তার চিৎকারে এলাকাবাসীর হাতে আটক হয় তিনজন। পালিয়ে যান সাবেক ড্রাইভার মাসুদসহ চারজন।
নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপহরণ ও নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি মাসুম ওরফে মাসুদসহ জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তাররা হলেন- মামলার প্রধান আসামি মো. মাসুম ওরফে মাসুদ (৪২), সহযোগী আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনি (৪৮)।
র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১ ও র্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) মধ্যরাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত ১৭ই আগস্ট রাত আনুমানিক সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর একজন নারী যুগ্ম কর কমিশনার রাজধানীর মগবাজার এলাকায় কতিপয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক অপহৃত হন। পরবর্তীতে অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী নিজেই তার সাবেক গাড়ি চালক মাসুদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
এলাকাবাসী কর্তৃক আটক তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখায় রমনা থানা পুলিশ। তারা হলেন- সাইফুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দীক ও ইয়াছিন আরাফাত ওরফে রাজু। একই ঘটনায় জড়িত শান্ত পলাতক রয়েছে।
ওই ঘটনায় র্যাব অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গত রাতে মামলার প্রধান আসামি মাসুম ওরফে মাসুদ সহযোগী আব্দুল জলিল ও হাফিজকে গ্রেপ্তার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার তিনজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদ পূর্বে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১লা আগস্ট ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তাকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেন। ফলে গ্রেপ্তার মাসুদের মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রোশের সৃষ্টি হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মাসুদ জানান, তাকে চাকরিচ্যুতির পর ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তাকে উচিত শিক্ষা দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়।
হারুণ এজন্য অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেয়। কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবন যাপন করার সকল ব্যবস্থা করে দিবে বলে আশ্বাস দেয়।
গত ১৫ই আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় গ্রেপ্তার মাসুদ তার পরিচিতি হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানায় ও সবাইকে টাকা ভাগ করে দেয়। তারা রাজধানীর বেইলী রোড এলাকা হতে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়ি চালকের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়িচালক থেকে জেনে মাসুদকে জানায়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৭ই আগস্ট রাত ৮টার দিকে তারা রাজধানীর বেইলী রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। ভুক্তভোগী রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর মগবাজার থেকে নিজ গাড়িযোগে বেইলী রোড এলাকায় পৌঁছলে একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে গতিরোধ করে। এসময় ভুক্তভোগীর ড্রাইভার মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করে। মাসুদ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
গ্রেপ্তার মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানান, নারী কর কর্মকর্তাদের অপহরণের পরই বিষয়টি প্রথম স্বামী হারুণকে জানানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই ৫০ হাজার টাকায় হাতিরঝিলে ভাড়া করা একটি বাসার ঠিকানা নেয়ার কথা জানান হারুণ। কিন্তু সেখানে বাসার মেইন গেট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদের দেয়া তথ্যমতে, বাসায় ঢুকতে না পারায় সাবেক স্বামী হারুণ ভুক্তভোগী নারীকে রাতে অন্যত্র রাখার নির্দেশ দিলে মাসুদ গাড়িসহ রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে যায়।
সেখানে নেবার পথে অপহৃত নারীকে নির্যাতন করা হয়, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয়।
পরদিন ১৮ই আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যায়। সেখানে জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করে। এ সময় গ্রেপ্তার মাসুদ ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করে। তিনি জুমা নামাজের পর হাতিরঝিলের সেই আগের বাসায় নেবার নির্দেশ দেন। দুপুরে খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যায় এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি বাইরে পাহারায় থাকে। এসময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে। মাসুদ, পনু ও শান্ত পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
গ্রেপ্তার মাসুদ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ২৫ বছর যাবৎ পেশায় গাড়ি চালক মাসুদ পূর্বে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালিয়েছেন। পরবর্তীতে বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্স বাতিল হয়। এছাড়াও তিনি গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল বলে জানা যায়।
নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের পর আত্মগোপন সম্পর্কে মাসুদ জানায়, রাজধানীর বাবু বাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুর শ্রীপুর এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন মাসুদ। পরবর্তীতে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তার পনু পেশায় একজন সিএনজিচালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে গ্রেপ্তার মাসুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার মাসুদ তাকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করে।
গ্রেপ্তার হাফিজ দূরপাল্লার বাসচালক। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে গ্রেপ্তার মাসুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা।
নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক স্বামী হারুন কোথায়? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি মগবাজারের বাসাতেই অবস্থান করছেন বলে জেনেছি।
অপহরণে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়ে কেন এখনো তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি- জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানলে জানতে পারে। তবে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর মামলার মূল আসামি মাসুদ আজ সকালে নারী কর কর্মকর্তা অপহরণে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক স্বামী হারুণের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। হারুণের নাম মামলার এজাহারে নেই। যেকারণে প্রাপ্ত তথ্য তদন্ত সংস্থাকে জানানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।
আরো পড়ুন : কাজে নয় সরকারের মুখে গণতন্ত্র: মঈন খান