ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। একদিনে আরও ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আগস্টে মৃত্যু ৩৪২ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯৩ জনে। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যু ও শনাক্তে পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আগস্ট মাসেই পুরো বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগই ডেঙ্গু সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী বাড়লেই মৃত্যু বাড়বে। আর এতে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে নারী, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠী এবং শিশুরা। আর ডেঙ্গুর এই সময়ে স্থানীয় সরকারকে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু কেন বেশি জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এবার ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ মনে হচ্ছে রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন।
ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলো মৃত্যুর প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যাবে। এখনো আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য পাইনি। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনায় তেমন সময় দেয়া হয় না। ফলে গবেষণার ক্ষেত্র খুবই কম। এবছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেন এই বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছরে মে মাসের শেষদিক থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশে যে সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হয়, তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা এবার ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেহে জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এরপর পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক ওষুধ বা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।
ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৩০৮ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৭৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৪৩৩ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৩০৮ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৭৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ৮১৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪ হাজার ৫৬১ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ৭৬ হাজার ৮৬৫ জন এবং নারী ৪৬ হাজার ৯৮৩ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৭ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ৩৪২ জন।
ডেঙ্গু রোগীদের ৬২ শতাংশ ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত: চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড এরই মধ্যে ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগই ডেঙ্গু সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচও প্রকাশিত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬২ শতাংশই সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
এছাড়া ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ২৯ শতাংশ এবং ডেন-২ ও ডেন-৩ দ্বারা একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে ১০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের জরিপের তথ্যের বরাতে ডব্লিউএইচও এ তথ্য জানিয়েছে। ৩২৫ জনের ডেঙ্গু রোগীর ওপর চালানো জরিপে এই তথ্য পাওয়া যায়। গত ২৮শে আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় আগেই বাড়তে শুরু করেছিল। চলতি বছর ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। এ ছাড়া একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জনের মৃত্যু হয়।
আরো পড়ুন : এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা