কাওছার আহমদ, সিলেট: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আবুল হারিছ চৌধুরী এখনও পলাতক থাকলেও পরিবারের দাবি তিনি মারা গেছেন। গত রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) পরিবারের উদ্যোগে তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার পূর্ব দর্পনগরে দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হয়েছে । এতে আত্মীয় স্বজন, শুভাকাঙ্খী ও এলাকার লোকজনের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীরা অংশ গ্রহণ করেন। অনুষ্টানে আসা দলের অনেক নেতাকর্মী আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলেন, হারিছ চৌধুরীর ‘কবর’ টা গ্রামে থাকলে অন্তত জিয়ারত করা যেতো। কিন্তু লাশটাও দেখার সুযোগ হয়নি এলাকার লোকজনের।
এসময় দলের নেতাকর্মীদের এই আবেগের সাথে একমত পোষণ করে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম সহ সভাপতি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন) উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, হারিছ চৌধুরী ছিলেন বড়মাপের নেতা। জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন তাঁর হাত দিয়েই হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে এই নেতার লাশ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে এনে মা-বাবার কবরের পাশেই শায়িত করা হবে। এতে এলাকার জনগণের মনের আকাঙ্খা পূরণ হবে। তিনি আরও বলেন, এখন থেকে জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয়ভাবে পালন করবে।
রাজনীতিতে হারিছ চৌধুরী ছিলেন রহস্যপুরুষ। তাঁর মৃত্যুটাও যেন গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে মৃত্যুর বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তীতে ২০২১ সালের শেষ দিকে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী গণমাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই সময় আশিক চৌধুরী জানান, যুক্তরাজ্যে হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। কিন্তু এরপরই হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী জনসম্মুখে আসেন। তিনি চাচা আশিক চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্য অসত্য দাবি করে গণমাধ্যমকে জানান, তাঁর বাবা দেশেই ছিলেন। ঢাকার পান্থপথে একটি বাসায় থাকতেন। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাও নিয়েছেন।
হারিছ চৌধুরীর মেয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে ওই সময় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় ঢাকার সাভারের একটি মাদরাসায় তাকে দাফন করা হয়। জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন নামক মাদরাসায় ৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে ওই মাদরাসার কবরস্থানে দাফন করা হয় হারিছ চৌধুরীকে। দাফনের ব্যাপারে মাদরাসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে। তবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানতেন না যাকে ওই কবরস্থানে দাফন করা হচ্ছে তিনি হারিছ চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী পান্থপথের যে বাসায় থাকতেন সেখানে তিনি মাহমুদুর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। দাফনও হয়েছে মাহমুদুর রহমান নামে। এই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টও তৈরি করেন। লম্বা সাদা দাড়ি রেখে তিনি নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনায় তাকে কেউ চিনতে পারত না।
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী বলেন, তাঁর বাবাকে দলমত নির্বিশেষে এলাকার সবাই ভালোবাসতেন। প্রায় ১৫ বছর এলাকার মানুষ তাঁকে দেখতে পারেননি। এতে অনেকেই তাঁর বাবার জন্য মিস করেছেন। মৃত্যুর পর লাশটাও দেখার সুযোগ হয়নি। এলাকার মানুষের আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই আয়োজন। সামিরা চৌধুরী আরও জানান, তাঁর ভাই নায়েম শাফী চৌধুরী এবারের মৃত্যুবার্ষিকীর সব ব্যবস্থা করেছে। সে বিদেশ থেকে আসতে না পারায় বাড়িতে থাকা আত্মীয় স্বজন ও দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় সবকিছু হয়েছে।
হারিছ চৌধুরীর ছোটভাই কামাল চৌধুরী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, এলাকার প্রতি খুব টান ছিল হারিছ চৌধুরীর। প্রায়ই বলতেন তিনি মারা গেলে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের মানুষ যেনো তাঁর জানাজায় অংশ নেয়। গ্রামে বাবা-মা’র কবরের পাশেই যেন তাঁর দাফন হয় কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই সুযোগ হয়নি।
সাবেক ছাত্রদলনেতা ও কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সহ ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সাইদুল আলম মাছুম বলেন, হারিছ চৌধুরীর কবরে একমুঠো মাটি দেওয়ার জন্য লক্ষাধিক মানুষ এখনও অপেক্ষামান।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ‘হাওয়া ভবনের’ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ‘হাওয়া ভবনের’ ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি ‘হাওয়া’ হয়ে যান । ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার ঠিক আগে তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে অবস্থান করছিলেন বলে একটি সূত্র জানায়। এরপর তাকে নিয়ে বাড়তে থাকে রহস্যের ডালপালা। কখনো ভারতে, আবার কখনো যুক্তরাজ্য, ইরানসহ বিভিন্ন দেশে তার অবস্থানের কথা আলোচিত হয় গণমাধ্যমে। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা, ওই সময় তিনি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে তার নানাবাড়িতে পালিয়ে যান। এরপর কখনো শোনা যায়, তিনি মেয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আবার কখনো ইরানে তার ভাইয়ের কাছে আছেন। নানাবাড়ি অবস্থানকালে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট করে তাদের কাছে বেড়াতে গেছেন এমন গুঞ্জনও ওঠে নানা সময়। কিন্তু হারিছ চৌধুরীকে স্বচক্ষে কোথাও দেখা গেছে এমনটা বলতে পারেননি কেউ।
প্রসঙ্গত, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন আবুল হারিছ চৌধুরী। এই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া হত্যা মামলারও আসামি তিনি। ২০১৫ সালে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করে।
হারিছ চৌধুরী ১৯৪৭ সালে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নানাবাড়ি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে। তিনি ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে এমএ পাশ করেন।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের জাগদলে যোগ দেন। বিএনপি গঠনের পর সংগঠনের সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে তিনি তাঁর বিশেষ সহকারী নিযুক্ত হন। ২০০১ সালে আবার বিএনপি সরকার গঠন করলে খালেদা জিয়া হারিছ চৌধুরীকে রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন।
কাওছার আহমদ
আরো পড়ুন: চোরাচালানের ‘নিরাপদ রুট’ সিলেটের ছয় সীমান্ত উপজেলা