দেশে ডেঙ্গুতে এবছরে মৃত্যু ১১০০ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা সোয়া ২ লাখেরও বেশি। অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর দাপট চলছে। সামনে এ পরিস্থিতি কতোদিন চলবে তারও কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। দেশের বড় দু’সিটির বাইরে এখন ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে নেই মশা নিধনের উদ্যোগ। এ ছাড়া বর্ষা দীর্ঘ হওয়ার কারণে ডেঙ্গু রোগী কমছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। বর্তমান রোগীর চেয়ে আরও ১০ গুণ বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই।
ডেঙ্গু রোগী কমছে না কেন-জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড) অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের বাহন হচ্ছে এডিস মশা।
এই মশা আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় সিটিতে বেশি ছিল। এসব শহরে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হতো। কম হোক, বেশি হোক মশা মারার জন্য এসব সিটিতে ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু এখন সারা দেশে এডিস মশা ছড়িয়েছে। ফলে সারা দেশ থেকে ডেঙ্গু জ্বরের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জেলা শহর বা উপজেলা পর্যায়ে মশা মারার উদ্যোগ দেখছি না। ফলে রোগী কমছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেন তিনি। আবহাওয়ার কারণে বর্ষা দীর্ঘ হচ্ছে। আশ্বিন মাসের শেষদিকে এসেও বৃষ্টি কমছে না। শীত দেরিতে আসছে। বর্ষা মৌসুম থাকলেই বৃষ্টি হবে। আর বৃষ্টি হলেই ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য সুবিধা হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখো হচ্ছেন। এই জনস্বাস্থ্যবিদ জেলা ও বিভাগীয় বড় বড় হাসপাতালগুলোকে আরও সক্ষম করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, চলতি মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন কমিউনিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন, জুলাইয়ে গিয়ে আমরা ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পেলাম। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে যায়। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দেয়া হয়, তার চেয়ে ১০ গুণ রোগী বেশি হবে। ২০২১ সালে দেখেছি অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এরপর পরবর্তী বছরে দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরে জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০’র মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশার নিধন করতে হবে। এডিস মশা যেখানে হয় সেখানে টার্গেট করে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে হয়তো আমরা পারছি না, কেন পারছি না, সেটা বের করতে হবে। এতদিন আমরা মশার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে চেপে ধরেছি। কিন্তু এখন আমরা দেখছি সারা দেশে মশা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের উপশহর, উপজেলাতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। কেউ জানে না কেন উপজেলাতে ডেঙ্গু হচ্ছে। সে গবেষণাটা কে করবে, সে গবেষণার ফাইন্ডিং কে দেবে সেটি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এটা ভাবলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাকে আরও জোরদার করবে বলে জানান কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। এখন থেমে থেমে বৃষ্টিটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছরে মে মাসের শেষদিক থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। তা এখনো বলবৎ রয়েছে।
ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ১১০০ ছাড়িয়েছে: দেশে ডেঙ্গুতে এবছরে মৃত্যু ১১০০ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা সোয়া ২ লাখেরও বেশি। একদিনে ডেঙ্গুতে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ১০৯ জনের প্রাণ গেছে ডেঙ্গুতে। অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর দাপট চলছে। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ১২০ জন। একদিনে আরও ২ হাজার ৫৫৫ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যু ও শনাক্তে পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি গ্রামে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৮৯ হাজার ৪৬০ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩১৯ জন। মৃত ১ হাজার ১০৯ জনের মধ্যে নারী ৬২৬ জন এবং পুরুষ ৪৮৩ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৪০৯ জন এবং রাজধানীতে ৭০০ জন।
ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৫৫৫ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬১৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৯৩৮ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৫৫৫ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬০২ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৬৮৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৯১৯ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪২১ জন এবং নারী ৯০ হাজার ৩৫৮ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৮ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ৩৪২ জন। সেপ্টেম্বরে শনাক্ত রোগী ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন এবং মারা গেছেন ৩৯৬ জন। অক্টোবরের ১০ দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৩৭৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ১২০ জন।
আরো পড়ুন : অনলাইনে চলা আইস টেকনাফ থেকে ঢাকায় যেভাবে