স্টাফ রিপোর্টার : ৪ বছর আগে ঢাকার সদরঘাটে মিতালি-৭ লঞ্চের কেবিনে খুন হওয়া চাঞ্চল্যকর নিলুফা বেগম (৫৭) হত্যার রহস্য উন্মোচনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্রুনাই প্রবাসী মো. দেলোয়ার মিজি (৪৪)কে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই ঢাকা জেলা। গত ২২শে সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরকীয়া প্রেমিকাকে ঢাকায় এনে বিয়ের আশ্বাসে ২০১৯ সালের ১৬ই জুন চাঁদপুর থেকে লঞ্চে রওনা দেন দেলোয়ার মিজি। লঞ্চের কেবিনেই ওই নারীকে ধর্ষণের পর খুন করে সকালে ঢাকায় নেমে যান তিনি। ১৭ই জুন সকালে লঞ্চের কেবিন থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গতকাল ধানমণ্ডি পিবিআই সদর দপ্তরে অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান আসামি ভুক্তভোগীর প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু ঘটনার আগে-পরে জাহাঙ্গীরের কোনো মুভমেন্ট না পাওয়ায় অন্যপথে হাঁটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তদন্তে ভুক্তভোগীর সঙ্গে একই গ্রামের একটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ দেখে সেখানে খোঁজ নেয়া হয়। দেখা যায়, নম্বরটি প্রতিবেশী এক নারীর। ওই নারীর সঙ্গে ভুক্তভোগীর কথা হতো।
তবে ওই নারী জানান, তার ব্রুনাই প্রবাসী স্বামী দেশে ফিরলে মাঝেমধ্যে তার মোবাইলটি ব্যবহার করেন। তিনি ২৬শে জুন ব্রুনাই চলে গেছেন। একপর্যায়ে ব্রুনাই প্রবাসী দেলোয়ার মিজির সঙ্গে নিলুফার পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি সন্দেহ হয়। পিবিআই দেলোয়ার মিজির পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অবহিত করে।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এরমধ্যে আমরা ওই এলাকায় কোনো তৎপরতা দেখাইনি। যাতে সবাই বুঝতে পারে পুলিশের এ নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা দেলোয়ারের দেশে ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় সাড়ে ৪ বছর অপেক্ষার পর গত ২২শে সেপ্টেম্বর দেশে ফিরলে ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসে রহস্য।
প্রাথমিকভাবে দেলোয়ার কোনোভাবেই নিলুফার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক বা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করছিলেন না। তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন জানান, তাই সেটিও খোলা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা র্যানডম পার্সওয়ার্ড বসিয়ে ফোনটি আনলক করতে সক্ষম হন। খুঁজতে খুঁজতে তার হোয়াটসঅ্যাপে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েজ মেসেজেই বেরিয়ে আসে ক্লু। দেশে আসার কিছুদিন আগে পাঠানো ওই ভয়েস মেসেজে নিলুফা হত্যা মামলার খোঁজখবর নিতে বলেন এবং মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সেটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেন। দেশে এলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসেই তিনি ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশে আসেন। এরপর এ বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দেলোয়ার মিজি নিলুফা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার মিজি জানান, নিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে তার বাড়িতে কাঠমিস্ত্রির কাজের সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালে তিনি ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের কথাবার্তা চলতে থাকে। ২০১৯ সালের ২৮শে এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি নিলুফার সঙ্গে একাধিক বার শারীরিক সম্পর্ক করেন। এরপর নিলুফা তাকে বিয়ের চাপ দিতে থাকেন। তিনি নিলুফাকে বিয়ে করবেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলে তার বাড়িতে গিয়ে উঠবে বলে হুমকি দিতে থাকেন। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে নিলুফা সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন। মান সম্মানের কথা চিন্তা করে নিলুফাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেলোয়ার এবং নিলুফা ১৬ই জুন রাতে চাঁদপুর থেকে মিতালি-৭ লঞ্চের তৃতীয় তলার এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। লঞ্চ ছাড়ার পর রাত ১২টার দিকে তিনি নিলুফার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। রাত দেড়টার দিকে বিয়ের কথা নিয়ে নিলুফার সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তিনি ওই নারীকে গলা চেপে ধরেন। পরে তার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
আরো পড়ুন : তাৎক্ষণিক লোনের অ্যাপ নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে