বাংলাদেশে আছে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রীতি। আছে গতিশীল মিডিয়া, সক্রিয় নাগরিক সমাজ, রাজনীতিতে যুক্ত নাগরিকরা। কয়েক দশকে দেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০৪১ সালে একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার ভিশন অর্জনের জন্য এসব একটি শক্ত ভিত্তি রচনা করেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্ত্বেও বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে তা নির্বাচনী সততার প্রতি বড় রকমের বাধা সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে আছে আপসহীন এবং জিরো-সাম (সবকিছু অথবা কিছুই নয়) রাজনীতি। উচ্চ মাত্রায় বাগাড়ম্বরতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা ও ভীতির বিস্তৃত আবহ, নাগরিক সমাজ ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্থান সংকুচিত হয়ে আসা। এ ছাড়া আছে নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা এবং এর অংশীদারদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট।
নারী, যুবশ্রেণি ও অন্য প্রান্তিক গ্রুপগুলো অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধার মুখোমুখি। গণতান্ত্রিক মূলনীতির প্রতি এসব চ্যালেঞ্জ হুমকি।
এর ফলে দেশটির টেকসই উন্নয়নের দিকে যে ইতিবাচক প্রক্ষেপণ তা খর্ব হতে পারে। বাংলাদেশ এখন সন্ধিক্ষণে। আসন্ন নির্বাচন হলো দেশটির গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিশ্রুতিতে একটি লিটমাস টেস্ট। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী মূল্যায়নে এসব কথা বলেছে ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট (এনডিআই)। এ জন্য ৬ জন প্রতিনিধির একটি মার্কিন টিম ৮ অক্টোবর থেকে ১১ই অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেন।
এ সময়ে তারা সাক্ষাত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ইউএসএইডের সাবেক ডেপুটি এডমিনিস্ট্রেটর বোনি গ্লিক (আইআরআই সহসভাপতি), দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল এফ ইনডারফার্থ (এনডিআই সহসভাপতি), মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য মারিয়া চিন আবদুল্লাহ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাবেক এসোসিয়েট কাউন্সেল জামিল জাফের, আইআরআইয়ের সিনিয়র পরিচালক (এশিয়া প্যাসিফিক ডিভিশন) জোহানা কাও এবং এনডিআইয়ের আঞ্চলিক পরিচালক (এশিয়া প্যাসিফিক) মানপ্রীত সিং আনন্দ। সফর শেষে এই প্রতিনিধি টিম রিপোর্ট দিয়েছে। তারা নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের জন্য কিছু সুপারিশ বিবেচনার জন্য প্রকাশ করেছেন। বলা হয়েছে, এসব সুপারিশ একটি রোডম্যাপ, যা নির্বাচনের আগে এবং পরে বিশ্বাসযোগ্য, সবার অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অহিংস নির্বাচনের দিকে অগ্রগতি অর্জনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবে।
সুপারিশগুলো হলো- ১. নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে পারে পরিমিত কথাবার্তা, উন্মুক্ত এবং গঠনমূলক সংলাপ। ২. মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজের কথা বলার স্থান নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। ৩. অহিংস থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং রাজনৈতিক সহিংসতাকারীদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে। ৪. সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা। ৫. নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সক্রিয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে হবে।
এসব সুপারিশের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে কথাবার্তায় উদার হওয়া উচিত। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈধতাকে স্বীকার করতে হবে। মেনে চলতে হবে আচরণবিধি। বর্তমানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে আপসের জন্য সুস্থ বিশ্বাসে সমঝোতায় যুক্ত হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে। সৃষ্টি করতে হবে বাস্তব, টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তন। সব রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন অংশ এবং বাংলাদেশ ইস্যুতে সমালোচনামূলক রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে হবে সাংবাদিক ও মিডিয়া আউটলেটকে। নাগরিকদের স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে দেয়া উচিত। উভয়ক্ষেত্র প্রতিশোধ নেয়ার আতঙ্কমুক্ত থাকতে হবে। যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুতে কাজ করে তারাসহ নাগরিক সমাজের সংগঠন ও কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠনকে তাদের কর্মকাণ্ড খর্ব করা বা সীমিত করার হুমকির মুখে ফেলা উচিত হবে না। নতুন পাস হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বা এই আইন লঙ্ঘন করা উচিত হবে না। এর মধ্যে আছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বক্তব্যের কারণে তাকে টার্গেট করা। এ আইন বাস্তবায়নে নাগরিক ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে নেয়া উচিত সরকারের।
নির্বাচনী রেজ্যুলেশনে নিশ্চিত করতে হবে যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সব রকম সুযোগ পাবেন নাগরিক পর্যবেক্ষকরা। আইনগত ও অহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে সহিংসতার মুখে পড়া উচিত হবে না। সব দলকে প্রকাশ্যে অহিংস থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং তাদের নিজেদের সদস্য বা সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানাতে হবে। নির্বাচনে অহিংসতা নিশ্চিত করতে বহুদলীয় আচরণবিধির সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত সব দলের। নির্বাচনে নারীর বিরুদ্ধে অনলাইন ও অফলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধ, চিহ্নিত করা এবং সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য অংশীদারদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা শক্তিশালী করতে হবে। তাদের স্টাফ বৃদ্ধি করে এবং তহবিল যোগান দিয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিতে হবে, যারা অহিংসতায় জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্যতা দেখায়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজের নেতা এবং মিডিয়ার প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সব মুলতবি বিচারিক মামলার দ্রুত এবং বিশ্বাসযোগ্য বিচারিক রিভিউ করতে হবে। নির্বাচন যাতে অহিংস হয় এমন পরিবেশ বজায় রাখতে সব অংশীদারকে অবদান রাখা উচিত।
আরো পড়ুন :আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দারুস সালাম এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী খুন