ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাফেদা ও এবিবির যৌথ সিদ্ধান্ত না মানলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা বলেছে, ডলার বেচাকেনার ক্ষেত্রে এবিবি ও বাফেদা যৌথভাবে যেসব সিদ্ধান্ত নেবে সেগুলো মেনে চলতে হবে। যেসব ব্যাংক মানবে না তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া নীতি-সহায়তা আটকে দেওয়া হতে পারে।
বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের লাইসেন্সধারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এমন কঠোর বার্তা দেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের একক দর ও বাজারে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বাফেদা ও এবিবির পক্ষ থেকে যেসব যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেগুলো অনেক ব্যাংক মানছে না। তারা ডলারের নির্ধারিত দাম না মেনে বেশি দামে বেচাকেনা করছে। বাফেদা ও এবিবি ১ নভেম্বর থেকে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১১১ টাকা, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ডলার কেনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দিতে পারবে। ২২ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারবে। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ করলে প্রণোদনা দাঁড়ায় মোট ৫ শতাংশ। এ হিসাবে প্রতি ডলারের দাম পড়ে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা ৯ পয়সা। কিন্তু ১ নভেম্বর থেকে প্রণোদনার এ সীমা তুলে দেয় বাফেদা ও এবিবি। তারা বলেছে, ব্যাংকগুলো পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী যে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে। তবে এ প্রণোদনার কারণে ডলার কেনার যে খরচ বাড়বে তা ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে সমন্বয় করতে হবে। কোনো ক্রমেই ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ গ্রাহকের ওপর চাপানো যাবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো এ সিদ্ধান্ত মানছিল না। তারা প্রতি ডলারে ১২ থেকে ১৩ টাকা প্রণোদনা দিয়ে ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছিল। কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে। চড়া দামে কেনা এসব ডলার বিক্রিও করেছে চড়া দামে।
নির্ধারিত দাম ১১১ টাকার সঙ্গে প্রিমিয়াম যোগ করে তারা আমদানিতে ডলার বিক্রি করেছে ১২২ টাকা দামে। তবে রপ্তানি আয় থেকে পাওয়া ডলার ১১১ টাকা করেই বিক্রি করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ডলার কেনার গড় দামে বিক্রি করেছে। এতে তাদের ডলারের দাম পড়েছে গড়ে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা। এছাড়া কোনো কোনো ব্যাংক নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামেও রপ্তানি আয়ের ডলার কিনছে। তবে ওইসব ডলারের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করছে অন্য প্রক্রিয়ায়। এভাবে ব্যাংকগুলো ডলার সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এতে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে অন্যান্য খাতেও ডলারের দাম বাড়ছে। ব্যাংকে নগদ ডলারের দাম ১১৬ টাকায় ওঠেছে। খোলা বাজারে এর দাম বেড়ে দিনের শুরুতে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায় ওঠে। শেষ দিকে তা ১২৭ টাকায় বিক্রি হয়। তবে কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি দামে বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে বন্দর এলাকায় নগদ ডলারের দাম বেশি। কারণ বিদেশে যাওয়ার সময় তারা বিমান বা স্থলবন্দর থেকে নগদ ডলার কিনছে। ফলে ওইসব স্থানে ডলারের চাহিদা বেড়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বুধবার বাফেদা ও এবিবি যৌথ বৈঠক করে রেমিট্যান্সের ডলারের দামে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রেমিট্যান্স কেনায় ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় অপরিবর্তিত রাখে। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্সের ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা দেওয়া যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এ হিসাবে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনার সঙ্গে ব্যাংকের প্রণোদনা ২ শতাংশ রাখতে হচ্ছে। এর ৩ সপ্তাহ আগে তারা ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনা আড়াই শতাংশ দিতে পারবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১ নভেম্বর আবার ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনার সীমা তুলে দেয়। এখন আবার প্রণোদনা কমিয়ে ২ শতাংশের মধ্যে রাখতে বলেছে। বৃহস্পতিবার বলেছে রেমিট্যান্সের ডলারে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা দেওয়া যাবে। ফলে এ খাতে ব্যাংক নিজস্বভাবে আবার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া যাবে। গত ৩ সপ্তাহে রেমিট্যান্স কেনার ব্যাপারে বাফেদা ও এবিবি চার দফা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।
ব্যাংকাররা বলেছেন, বাফেদা ও এবিবির ঘন ঘন এসব সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে বাজারে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এতে বাজারে অস্থিরতা আরও বাড়ছে। তারা ডলারের ব্যাপারে একক ও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তে আসার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এদিকে আইএমএফ ও অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এর সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ এই মুহূর্তে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠবে। এ কারণে বাফেদা ও এবিবির মাধ্যমে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেদিকেই হাঁটছে। সংগঠন দুটি যে সিদ্ধান্ত নেবে তা সব ব্যাংককে মানতে হবে। না মানলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে এবিবি ও বাফেদা রেমিট্যান্সের ডলারের দাম বুধবার সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা বেঁধে দিলেও অনেক ব্যাংক তা কার্যকর করেনি। কারণ তারা আগেই ১২২ থেকে ১২৩ টাকা রেমিট্যান্সের ডলার কেনার আদেশ দিয়ে রেখেছেন বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে। ফলে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বাড়তি দামে ডলার সংগ্রহ করে তাদের সরবরাহ করছে। এখন ওইসব ব্যাংকের পক্ষে ১১৫ টাকায় রেমিট্যান্সের ডলার কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এখন ১২২-১২৩ টাকা থেকে হঠাৎ করে ডলারের দাম কমিয়ে ১১৫ টাকা অফার করা হলে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ডলারের জোগান বন্ধ করে দেবে। তখন রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যাবে। এতে বাজারে সংকট আরও প্রকট হবে।
আরো পড়ুন : পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করায় বাংলাদেশি পোশাক বেশি দামে কিনবে বিদেশি ক্রেতারা