ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কে (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) যদি কোনো গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কী হবে?
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন—এমন লোকজনসহ কৌতূহলী অনেকের সাধারণ একটা প্রশ্ন এটি।
লোকজনকে এমন আলোচনা করতে দেখা গেছে যে এই পথে কোনো গাড়ি বিকল হলে বা গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে গেলে, কে সাহায্য করতে আসবে? সাহায্যের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? যাত্রীদের কী হবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর আজ সোমবার সকালে যেন চোখের সামনেই পাওয়া গেল।
সকাল ৯টা ৪৩ মিনিটে কুড়িল থেকে এই পথ দিয়ে কারওয়ান বাজারের গন্তব্যে যাওয়ার পথে দেখা গেল, এক্সপ্রেসওয়েতে ‘ভিআইপি’ নামের একটি বাস থেমে আছে।
বাস থেকে নেমে অন্তত ৩০ জনের মতো যাত্রী এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়ে আছেন। সবার চোখেমুখে অসহায়ত্ব।
ভুক্তভোগী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাসটি গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে রাজধানীর নিউমার্কেট গন্তব্যে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এক্সপ্রেসওয়েতে বাসটির পেছনের একটি চাকা ‘পাংচার’ (ফুটো) হয়ে যায়। এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার আগে বাসটির পেছনের অন্য একটি চাকা ফুটো হয়ে গিয়েছিল, তা সত্ত্বেও বাসটি চালিয়ে নিচ্ছিলেন চালক।
যাত্রীদের ভাষ্য, বাসটির ফিটনেসে সমস্যা আছে। চালকও দায়িত্বহীন।
এনায়েত নামের এক যাত্রী বললেন, তিনি উত্তরা থেকে বাসটিতে ওঠেন। এক্সপ্রেসওয়েতে বাসটির চাকা ফুটো হয়ে যাওয়ায় কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শুরু কাওলা থেকে। এক্সপ্রেসওয়ে যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত। এর মোট দূরত্ব ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। এই অংশের দূরত্ব সাড়ে ১১ কিলোমিটার। ২ সেপ্টেম্বর এই অংশের উদ্বোধন হয়। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই অংশে সাধারণ যানবাহনের চলাচল শুরু হয়।
আজ সকালে এক্সপ্রেসওয়েতে চাকা ফুটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিআইপি নামের বাসটির পাশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একটি গাড়ি দেখা গেল।
ঘটনাস্থলে বিআরটিএর জ্যাকেট পরা দুই ব্যক্তি মুঠোফোনে কাউকে বাসটির অবস্থা সম্পর্কে জানাচ্ছিলেন। তাঁদের একজনের নাম মোহাম্মদ নাসিম। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁরা চাকা ঠিক করে কীভাবে বাসটিকে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সরানো যায়, সেই ব্যবস্থা করছেন। এ ব্যাপারে সাহায্য করতে তাঁদের একটি দল ঘটনাস্থলে আসবে।
বাসটির যাত্রীদের কি অন্য কোনো গাড়ি দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে পার দেওয়া হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘গাড়ি দিয়ে হয়তো পার করার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তবে দেখা যাক, কী করা যায়।’
এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িই বেশি চলাচল করছিল। অনেক চালক বাসটির কাছে এসে ব্যক্তিগত গাড়ির গতি কমিয়ে দিচ্ছিলেন। ব্যক্তিগত গাড়ির চালকসহ আরোহীরা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে বাসটির দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাসটির কী হয়েছে, তা জানতে চাইছিলেন তাঁরা।
প্রশ্নের জবাব পেয়ে চালকেরা ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তবে একজনকে দেখা গেল, ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। গাড়িটি শাকিল আহমেদ নামের এক ব্যক্তির। তিনি বাসের দুই-তিনজন যাত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে ওঠার আহ্বান জানান।
শাকিল আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, লোকজন বিপদে পড়েছে। তাই তিনি যতটুকু পারছেন, সাহায্য করছেন।
বেশ কিছু পর ঘটনাস্থলে ‘ভিআইপি’ নামের আরেকটি বাস এসে থামে। একই কোম্পানির এই বাসটি থামার পর যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে ওঠার চেষ্টা করেন।
তুহিন আলম ও জহিরুল ইসলাম নামের দুজন যাত্রী এই প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত গাড়িতে ওঠেন। চলতি পথে দুজন জানান, অবরোধের মধ্যে আবদুল্লাহপুরের পলওয়েল মার্কেট এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই উদ্বেগের মধ্যে তাঁরা পড়লেন এক বিপদে। এক্সপ্রেসওয়ে বাসের চাকা গেল ফুটো হয়ে।
তুহিন আলম জানান, তিনি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে তাঁর বাসা। তিনি বাসেই যাতায়াত করেন। ভিআইপি কোম্পানির বাস এক্সপ্রেসওয়ে দিয়েও চলে। বাসটি বেশ কিছুটা পথ চলার পর পেছনের একটি চাকা ফুটো হয়ে যায়। তারপর চালক এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে দ্রুতগতিতে চালানো শুরু করেন। একপর্যায়ে পেছনের আরেকটি চাকাও ফুটো হয়ে যায়।
তুহিন আলম বলেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, বাসটি ফিটনেসবিহীন। চালকও দায়িত্বশীল নন। এসব দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।
জহিরুল ইসলাম নামে অপর যাত্রী বলেন, তিনি কারওয়ান বাজার এলাকায় অবস্থিতি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। উত্তরার জসিমউদ্দীন রোড থেকে তিনি বাসটিতে উঠেছিলেন। চাকা ফুটো হয়ে বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে থেমে গেলে তিনি অসহায় বোধ করেন।
তুহিন ও জহিরুল নামের এই দুই যাত্রীর অভিযোগ, বাস কোম্পানিটি যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে।
এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যান, বাইসাইকেল ও পথচারী চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে। স্বল্প দূরত্বে যাত্রী পাওয়া যায় না বলে খুব কম বাসই এই পথ ব্যবহার করে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) এই পথে আটটি বাস নামিয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি বিকল হওয়া নিয়ে এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক চালকের কথা মনে পড়ল। একদিন যাত্রী হিসেবে তাঁর অটোরিকশায় ছিলাম। প্রচণ্ড যানজটে বসে থেকে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘দেখছেন, উপরে (এক্সপ্রেসওয়ে) এত বড় রাস্তা বানাইল, কোনো লাভ হইল! সেই তো জ্যামই।’
সিএনজিচালিত অটোরিকশা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করছিলেন চালাক। তখন তাঁকে জানালাম, এটা দ্রুতগতির পথ। অন্যদিকে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তাই অটোরিকশা চলতে দেওয়া হলে অন্য দ্রুতগতির যানবাহনের চলাচল ব্যাহত হবে। তা ছাড়া এই পথে অটোরিকশা হুটহাট নষ্ট হলে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। এমন চিন্তা থেকেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলতে দেওয়া হচ্ছে না।
জবাবে চালকের মন্তব্য ছিল, ‘এই রাস্তায় অন্য গাড়ি নষ্ট হইতে পারে না? কখন কোন গাড়ি নষ্ট হইব, কেউ কইতে পারে?’
এক্সপ্রেসওয়ের টোল ও যানবাহন ব্যবস্থাপনা তদারকের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংস্থা ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হাইওয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) হাসিব হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ভিআইপি নামের বাসটির থেমে থাকার দৃশ্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দেখার পর ঘটনাস্থলে যান টহলকর্মীরা। বাসটির চাকা ঠিক করা হয়। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে বাসটি চলে যায়। এর আগেও চাকা ফুটো হয়ে বা বিকল হয়ে কিছু যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়েছিল। পরে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই পথে গতি বেশি। যানবাহনের চাকা দুর্বল থাকলে গতি ওঠাতে গিয়ে ফুটো হয়ে যেতে পারে।
হাসিব হাসান খান জানান, এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবস্থাপনায় চারটি টহল গাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাটবেড গাড়ি আছে। চাকা ফুটো না হয়ে যদি ব্যক্তিগত গাড়ি বিকল হয়ে যায়, তাহলে ফ্ল্যাটবেড দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। বাস-ট্রাক বিকল হলে ট্রাফিক পুলিশ ডেকে র্যাকার দিয়ে তা সরানো হয়। গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেলে, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে যাত্রীদের অন্য গাড়ি দিয়ে এক্সপ্রেসেওয়ে পার করে দেওয়া হয়। টোল টিকিটে হটলাইন নম্বর (০৯৬৭৮৭৭১৫৩১) আছে। এক্সপ্রেসেওয়েতে কেউ সমস্যায় পড়লে এখানে ফোন করেও সাহায্য চাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়েতে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। এই ক্যামেরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ হয়। এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে ক্যামেরায় দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে এক্সপ্রেসওয়েতে স্পিকার চালু হবে। এক্সপ্রেসওয়েতে কেউ গাড়ি নিয়ে থেমে থাকলে বা কোনো সমস্যার কারণে গাড়ি থেমে থাকলে স্পিকারের মাধ্যমে কথা বলে যোগাযোগ করা যাবে।