দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চুয়াডাঙ্গায় শহর-বাজার, পাড়া-মহল্লায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনি প্রচারে নেই বিএনপি। হামলা-মামলার ভয়ে আত্মগোপনে আছেন অধিকাংশ প্রার্থী। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবল তারা ভোট করবেন বলে জানিয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। এই সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এজন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছি। যদি নির্দলীয় কোনো সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়, তখন নির্বাচনে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে। এদিকে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতারা চান জেলার দুটি আসনই ধরে রাখতে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। ১৯৭৩ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার দুটি আসনই বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ (রব), জনতা মুক্তিপার্টি ও জামায়াতের দখলে ছিল। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে পালটে যায় দৃশ্যপট। ১৫ বছর ধরে দুটি আসনই আওয়ামী লীগের দখলে থাকায় বেড়েছে দলটির সাংগঠনিক দক্ষতা ও শক্তি। যদিও নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়ন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। দলীয় কর্মসূচিও তারা আলাদাভাবে পালন করেন। সংসদ-সদস্যদের সঙ্গেও নেতাকর্মীদের দূরত্ব আছে। তবে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায়, তবে পালটে যাবে সব হিসাবনিকাশ। জমে উঠবে নির্বাচন-এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা-১ (সদর-আলমডাঙ্গা) : এ আসনে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার বাদল রশীদ। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৮ সালে সংসদ-সদস্য হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। টানা তিনবারের সংসদ-সদস্য হওয়ায় এ আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। সংসদ-সদস্য ছেলুনের ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, বর্তমান সংসদ-সদস্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নিবিড়ভাবে দলের জন্য কাজ করছেন। নির্বাচনি এলাকা গুছিয়ে নিয়েছেন। এ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এবার মনোনয়ন পেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন বিজয়ী হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ আসনে সংসদ-সদস্য ছেলুন ছাড়াও বেশ কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হতে চান। নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এ আসনের সংসদ-সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের বয়স হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করলে আমিই মনোনয়ন পাব। অন্য যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার আশায় সভা-সমাবেশ করছেন, তারা পাঁচ মাসের প্রজেক্ট নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মনোনয়ন যুদ্ধ শেষ হলে মাঠ থেকে হারিয়ে যাবেন তারা। দলের হাইকমান্ড এবার চাচ্ছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী। সে হিসাবে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। নৌকার মনোনয়ন পেতে প্রচার চালাচ্ছেন ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি বলেন, আনুপাতিক হারে সংসদে ব্যবসায়ী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তাই আমি মনে করি, ব্যবসায়ী মহল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং যারা চুয়াডাঙ্গার উন্নয়ন চান, তারা আমার পাশে আছেন। তাই আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। নৌকার আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মাইওয়ান মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য এমএ রাজ্জাক খান রাজ। মনোনয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি দেশের মানুষের কল্যাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের মানোন্নয়নে কাজ করছি। আমি স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বাস করি।
নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম পানু বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্র জনগণের মাঝে তুলে ধরেছি। আশা করি, দলীয় মনোনয়ন পাব। নৌকার সম্ভাব্য প্রার্থী ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান সুমন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করছি। নৌকার মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হব বলে আশা রাখি। জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, জনপ্রিয়তা ও যোগ্য প্রার্থী হিসাবে দল যদি মনোনয়ন দেয়, তাহলে আমার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা ছাত্রলীগ সাবেক সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু নৌকার মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হতে চান। তিনি বলেন, আশা করছি, শেখ হাসিনা আমাকে নৌকার মনোনয়ন দেবেন। এছাড়া এ আসনে নৌকার মনোনয়ন চান সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিরিন নাঈম, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সামসুল আবেদীন খোকন ও জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আফরোজা পারভীন।
এদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি তোড়জোড় থাকলেও দলীয় কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিএনপি। ভোটের প্রচারে নেই তারা। গ্রেফতার আতঙ্কে দলের অধিকাংশ নেতা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ধানের শীষের মনোনয়ন চাইতে পারেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ-সদস্য শামসুজ্জামান দুদু, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব শরীফুজ্জামান শরীফ, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ কামরুজ্জামান ও ড. এমএ সবুর। জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফুজ্জামান শরীফ বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ২০১৮ সালে নির্বাচনে হেরে যান। জেলায় তার নেতৃত্বেই এখন দলীয় কর্মসূচি পালিত হয়। তিনি জানান, নির্দলীয় সরকারের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না।
চুয়াডাঙ্গা-২ (দামুড়হুদা-জীবননগর ও সদরের আংশিক) : এ আসনে ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আসহাব-উল হক নির্বাচিত হন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৮ সালে নৌকার প্রার্থী আলী আজগার টগর নির্বাচিত হয়ে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে নেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। এবারও তিনি নৌকার মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হতে চান। তবে এবার এ আসনের চিত্র ভিন্ন। সংসদ-সদস্য টগরের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হেভিওয়েট ১০ নেতা। তারা সভা-সমাবেশ করে টগরকে এবার নৌকার মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ-সংসদ-সদস্য টগর বিগত স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সরকারের উন্নয়নে সংসদ-সদস্য তার ৭ ভাইকে নিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে সংসদ-সদস্য আলী আজগার টগর বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আমাকে আবারও মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে আমি আশা করি।
জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, ২০১৩ সালে দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাচনে সংসদ-সদস্য আলী আজগার টগর কৌশলে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা আজিজুর রহমানের সঙ্গে আঁতাত করে আমাকে হারিয়ে দেন। এখানে প্রবীণ নেতারা অবহেলিত। সংসদ-সদস্য নৌকার বিপক্ষে কাজ করে ১৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীকে হারিয়েছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ। তারা নতুন সংসদ-সদস্য দেখতে চান। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পরিবর্তনের বিকল্প নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় আমি আশা করি, শেখ হাসিনা এবার আমাকে নৌকার মনোনয়ন দেবেন।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহফুজুর রহমান মনজু বলেন, ২০১৫ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাই। কিন্তু সংসদ-সদস্য টগর সরাসরি আমার বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বিজয়ী করান। ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে গত বছর আমি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের প্রবীণ-নবীনদের নিয়ে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করছি। সাধারণ মানুষের কাছে আমার জনপ্রিয়তা শীর্ষে। এসব বিষয় বিবেচনায় এবার দল আমাকে সংসদ-সদস্য নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দেবে বলে বিশ্বাস করি।
এছাড়া নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক সংসদ-সদস্য মির্জা সুলতান রাজার সহোদর মির্জা শাহরিয়ার মাহমুদ লন্টু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দর্শনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি এয়ার কমোডর (অব.) মো. আবু বকর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. হামিদুর রহমান, সামাজিক পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব মো. নূর হাকিম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সহসম্পাদক মো. হাশেম রেজা, জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপাধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জীবননগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবু মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ অমল, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল মল্লিক, কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য সাদিকুর রহমান বকুল, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য শাহরিয়ার কবির ও ঢাকাস্থ চুয়াডাঙ্গা জেলা সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সিরাজুল হক।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনের কথা ভাবছি না। তাই বিএনপির দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনাও নেই। যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তবে প্রার্থিতার বিষয়টি ভাবা যাবে। এছাড়া এ আসনে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
আরো পড়ুন : সানফ্রান্সিসকোতে আজ বাইডেনের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠক