টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার হাতছানি। ৭ জানুয়ারির ভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়তে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সে কারণে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে চমক দিচ্ছেন তিনি। সেই সঙ্গে সব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে কাল গণভবনে ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এলাকাবিচ্ছিন্ন, এমপি-মন্ত্রী থাকার পরও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে না পারা, শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিতর্কিত কাউকে এবার নৌকা দিয়ে জনগণের কাছে পাঠাবেন না। ক্লিন ইমেজ, জনগণের কাছে জনপ্রিয় এবং এলাকায় পরিচিত নতুন প্রার্থী দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সে হিসেবে দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এতে বাদ পড়ছেন অনেক হেভিওয়েট এমপি-মন্ত্রী-নেতা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কারা বাদ পড়ছেন তা নিয়ে অবশ্য কেউ মুখ খোলেননি। কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, বাদ দেওয়ার পরও অনেক সময় তাকেই প্রার্থী করা হয়, আবার ঘোষিত প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার নজির আওয়ামী লীগের আছে। সে কারণে এবার কঠোর গোপনীয়তা রাখা হচ্ছে। আগামীকাল আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে। বৃহস্পতিবার রংপুর, রাজশাহী চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল আরও চার বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে কাদের বলেন, আরও চারটি বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। নতুন অনেকে এসেছেন, কিছু বাদও পড়েছেন। উইন্যাবল (জয়ী হওয়ার মতো) প্রার্থী আমরা বাদ দিইনি। যারা উইন্যাবল-ইলেকট্যাবল না, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন, নারী-পুরুষ সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই মনোনয়নে এটা প্রযোজ্য। কৌশলগত কারণে কোন কোন বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, তা আর প্রকাশ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, একসঙ্গে ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। দুটি দিন অপেক্ষা করুন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের দুজন প্রভাবশালী সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, ‘দেশের আট বিভাগের মধ্যে ছয়টির প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় ও সংসদে থাকা অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রী-এমপি ও নেতা মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগসহ শারীরিক অসুস্থতাও রয়েছে।’ কারা বাদ পড়েছেন সে নাম প্রকাশ করতে চাননি তারা। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও সংসদীয় দলের বৈঠকে দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আমি জরিপ দেখে নৌকা দেব। মুখ দেখে নয়। এজন্য প্রতি ছয় মাস পর পর তিনি বিভিন্ন সংস্থা ও নিজস্ব লোক দিয়ে জরিপ চালিয়েছেন। সেই জরিপে যারা এগিয়ে আছেন এবার তাদেরই নৌকা তুলে দেবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ জরিপেও অনেক হেভিওয়েট এমপি-মন্ত্রীর ব্যাপারে নেতিবাচক তথ্য উঠে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের পৃষ্ঠপোষকতা, ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা এবং দলীয় নেতাদের উপেক্ষা করে নিজের গ্রুপের পক্ষে অবস্থান নেওয়া- তাদের বিতর্কিত হওয়ার মূল কারণ। এ ছাড়া ঢাকায় থেকে এপিএস-আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিযোগ রয়েছে। আট বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও উত্তরাঞ্চলের সংসদ সদস্যরা অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে দলীয় আনুকূল্য বেশি হারিয়েছেন। এসব বিতর্কিতদের পরিবর্তে তরুণ, জনপ্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের দলীয় টিকিট দেওয়া হচ্ছে। দলের সেবা করার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সাবেক সংসদ সদস্যরাও মনোনয়ন পাবেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও দলীয় কমিটিতে নেতা মনোনয়নে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব, টেন্ডারবাজি, টাকার বিনিময়ে মানুষকে চাকরি দেওয়া এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকায় দলের অনেক সংসদ সদস্যই দলীয় শৃঙ্খলার কথা ভুলে গেছেন। তাদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে দাম্ভিকতা দেখিয়েছেন। তারা এমপি-মন্ত্রী থেকেও এলাকায় যাননি, করোনাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকার মানুষের পাশে থাকেননি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি করেছেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে এমপি লীগ, ভাই লীগ সৃষ্টি করেছেন। তাদের এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্লিন ইমেজের প্রার্থী দিয়েই টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সে কারণে বিতর্কিতদের মনোনয়ন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারা বাদ পড়েছেন, আর কারা নতুন মুখ হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন তা জানতে চোখ রাখতে হবে রবিবার পর্যন্ত। ওইদিন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা দেবে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সরকারপ্রধান হন ১৯৯৬ সালে। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভূমিধস বিজয়ে সরকার গঠন করে টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বসবেন শেখ হাসিনা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আগামীকাল সকাল ১০টায় দলটির সভানেত্রী ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনা। সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত দলের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সব সদস্য এবং দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী সব প্রার্থীকে (জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মনোনয়নপত্রের রিসিভ কপি, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইন ফরমের ফটোকপিসহ) যথা সময়ে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। এতে দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার সকালে তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভবনে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। গতকালও মুলতবি সভা হয়। দুই দিনে রাজশাহী ও রংপুরের পর আরও চারটি বিভাগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আরো পড়ুন : রূপগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে টেম্পু হোসেন থেকে ভূমিদস্যু মোহাম্মদ হোসেন