স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকার কেরানীগঞ্জে বাবা-ছেলে হত্যার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মো. আরিফ ওরফে সরিফুল ইসলাম (৫২)কে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গত বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১৩ই জুলাই মুদি ও চায়ের দোকানদার শরিফুল ও তার ৯ বছরের ছেলে খোকনকে সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করে। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে কেরানীগঞ্জ এলাকায় মালোপাড়া বারিশুর বাজারে এ ঘটনা ঘটে। সন্ত্রসীরা শরিফুলের ১২ বছর বয়সী আরেক ছেলে শাহজাহানকেও কুপিয়ে জখম করেছিল। এই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির একজন আরিফ। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আরিফ বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। সে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় এসে তার নাম ও পরিচয় গোপন করে মো. সরিফুল ইসলাম নামে একটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন এবং ঢেউটিন ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন। পরে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ হয়ে গেলে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মুদি ও লন্ড্রি দোকানের ব্যবসা করে আসছিল। বাবা-ছেলের হত্যার ঘটনায় তখন এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, নিহত শরিফুলের দোকানে প্রায়ই মধ্যরাত পর্যন্ত বেচা-কেনা হতো। তার দুই ছেলে খোকন ও শাহজাহান প্রায় প্রতিদিনই রাতে বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন এবং রাতের খাবার শেষে তারা দোকানেই ঘুমিয়ে পড়তেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ও তার অন্যান্য সহযোগীরা কেরানীগঞ্জ এলাকায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা কেরানীগঞ্জ এলাকায় মাদক সেবন ও মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আরিফ ও তার সহযোগীরা দেশীয় অস্ত্র ক্যাশ বক্স থেকে নগদ টাকা ও বিভিন্ন মালামাল ছিনিয়ে নিতো। ঘটনার দিন দোকানি শরিফুল রাতে দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং দোকানের পেছনের অংশে তার দুই ছেলে ঘুমাচ্ছিল। ওই সময় শরিফুলের দোকানে আরিফ ও তার সহযোগীরা এসে সিগারেট ও অন্যান্য মালামাল জোর করে ছিনিয়ে নিলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এ সময় দোকানের ক্যাশ বাক্স থেকে নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে দোকানি শরিফ বাধা দেয়। এতে আরিফ ও তার সহযোগীরা ক্ষিপ্ত হয়ে শরিফুলকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তার চিৎিকার শুনে দোকানের পেছনের অংশে ঘুমিয়ে থাকা দুই ছেলে বাবাকে বাঁচাতে ছুটে আসে। কিন্তু তার দুই ছেলেকেও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। পরদিন ভোরে স্থানীয়রা শরিফুলের বড় ছেলেকে খবর দেয়। তার বড় ছেলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পায় তার বাবা শরীফ ও তার ছোট ভাই খোকন মারা গেছেন এবং আরেক ভাই শাহজাহান গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় শাহজাহানকে আহত অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় নিহতের বড় ছেলে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৯৯৪ সালের ২৬শে আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার আরিফসহ ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। ২০০৮ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক পুনঃবিচারের জন্য মামলাটি নিম্ন আদালতে পাঠানো হয়। নিম্ন আদালত সকল বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার আরিফসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে পূর্বে প্রদানকৃত মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।
তিনি বলেন, রায় ঘোষণার সময় শফিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম ওরফে নজু এবং মিস্টার ব্যতীত অপর দুই আসামি মো. আরিফ ও মো. মাসুদ পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আদালত সাজা পারোয়ানা ইস্যু করেন। র্যাব পলাতক আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে পলতক আসামি মো. আরিফ ওরফে সরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত আসমির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে টাঙ্গাইলের এক জনপ্রতিনিধিকে হত্যা পরিকল্পনা ছিল গ্রেপ্তার সিরিয়াল কিলার সাগর আলীর। তাকে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে কারাগার থেকে জামিনে বের করেন সেখানকারই এক রাজনৈতিক নেতা। টাঙ্গাইলের এক জনপ্রতিনিধিকে হত্যার জন্য তাকে কারাগার থেকে বের করা হয়। এই ঘটনায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকার আশুলিয়ায় একই পরিবারের ৩ জনকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় গত ২রা অক্টোবর গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে স্ত্রীসহ সিরিয়াল কিলার সাগর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার সাগর আলী এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা সাগর আলীকে গ্রেপ্তার করেছিলাম একই পরিবারের ৩ জনকে হত্যার ঘটনায়। এর আগে ২০১৮ সালেও একই পরিবারের ৪ জনকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। সাগর আলী জামিনে বের হয়ে এসে আবার একই পরিবারের ৩ জনকে হত্যা করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাগর র্যাবকে বেশকিছু তথ্য দিয়েছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি তাকে জামিন পেতে সহযোগিতা করেছেন বলে জানিয়েছে। সেই জনপ্রতিনিধি সাগরের জামিন এবং টাকা দিয়ে সহায়তা করেছে আরেকজন প্রতিনিধিকে হত্যার জন্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ হয়েছে, সেসবও সেই গণমাধ্যমের নিজস্ব অনুসন্ধান। তবে সাগর আমাদেরকে যে তথ্যগুলো দিয়েছেন, এগুলো সঠিক কিনা যাচাই-বাছাই করছি। এ ছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন। আমরা সাগরের কাছ থেকে যার নাম পেয়েছি, এ বিষয়ে তদন্ত করছি।