আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার চারটি আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান এক মন্ত্রী, সাবেক এক মন্ত্রী ও এক সংসদ-সদস্যের আয় বেড়েছে বহুগুণ। একই সঙ্গে বেড়েছে তাদের ঋণ। ঋণ সমন্বয় করলে তাদের সম্পদের চেয়ে তাদের স্ত্রীদের নামে সম্পদ বেশি। তারা সম্পদ অর্জনের সময় অনেক কম দামে জমি, ফ্ল্যাট ও স্বর্ণ কিনেছেন। বর্তমান বাজার মূল্যের তুলনায় এগুলোর দাম অনেক কম। সাবেক এক মন্ত্রীর টকশো ও ব্যাংকে থাকা অর্থ থেকে সুদ আয় বেড়েছে বহুগুণ।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামা ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের হলফনামা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তারা হলেন ঢাকা ১৯ নির্বাচনি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, ঢাকা-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম ও ঢাকা-২০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেনজীর আহমদ।
হলফনামার নিয়ম অনুযায়ী সম্পদ অর্জনের সময় এর মূল্য উল্লেখ করতে হয়। ফলে প্রার্থীরা বা প্রার্থীর স্ত্রী তাদের ওপর নির্ভরশীল অন্য ব্যক্তিদের নামে সম্পদ অর্জনের সময় কেনা মূল্যই হলফনামায় উল্লেখ করতে হয়। যে কারণে তাদের নামে থাকা সম্পদের মূল্য অনেক কম। আলোচ্য তিনজনের মধ্যে এনামুর রহমান ও বেনজীর আহমদের নামে ব্যবসার জন্য ঋণ নেওয়া আছে। ঋণ সমন্বয় করলে তাদের সম্পদের চেয়ে তাদের স্ত্রীদের সম্পদ বেশি থাকে।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ১৯ নির্বাচনি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের চেয়ে তার স্ত্রীর সম্পদ বেশি। অর্থাৎ তার চেয়ে স্ত্রী ধনী বেশি। স্ত্রীর চেয়ে এই মন্ত্রীর ব্যাংক ঋণ বেশি হওয়ায় তার নিট সম্পদ কম। ব্যবসার কাজে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের দায় ৮৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তিনি গত নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন তার মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত বলে এবারের হলফনামায় দাবি করেছেন।
এবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন নিজের কাছে নগদ অর্থ ছিল ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় নগদ ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ওই সময়ে তার স্ত্রীর কাছে নগদ অর্থ ছিল ১৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। এবার স্ত্রীর কাছে কোনো নগদ টাকা নেই। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এবার জমা ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ১ কোটি ৯ লাখ টাকা। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ এবার ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। একই বছরে স্ত্রীর নামে ছিল ১ কোটি টাকা। এবার নিজ নামে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে নিজ নামে ছিল ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ও স্ত্রীর নামে ছিল ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এসব বিনিয়োগ থেকে নিজ নামে মুনাফা পান ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। নিজ নামে গাড়িতে বিনিয়োগ ১ কেটি ৪৬ লাখ টাকা। নিজের নামে স্বর্ণ রয়েছে ৪০ ভরি। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। ফলে ৪০ ভরি স্বর্ণ কেনার সময় প্রতি ভরি এক হাজার টাকা করে ৪০ হাজার টাকায় কিনেছেন। ২০১৮ সালেও স্বর্ণ তাই ছিল। তবে ওই সময়ে স্ত্রীর নামে স্বর্ণ ছিল ৮০ ভরি, যার মূল্য জানা নেই বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এবারের হলফনামায় স্ত্রীর নামে স্বর্ণের কোনো উল্লেখ নেই।
ঢাকা-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলামের টেলিভিশন টকশো থেকে আয় বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের থাকা অর্থ থেকেও সুদ আয় বেড়েছে। নিজ নামে এবার বাড়ি ভাড়া থেকে বছরে আয় হয়েছে ৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। পেশা হিসাবে আইনজীবী উল্লেখ করেছেন তিনি। এই পেশা থেকে বছরে আয় ৯৫ লাখ টাকা। এখন বছরে টকশো করে আয় করেন ৫০ হাজার টাকা। ব্যাংক থেকে সুদ বাবদ আয় ৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এ দুটো মিলে বছরে আয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংক সুদ ও টকশো থেকে আয় হতো ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ খাতে আয় বেশ বেড়েছে। এবার নিজের কাছে নগদ অর্থ আছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার নগদ টাকা কমেছে। এবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ২ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ৪১ লাখ টাকা। এখাতে জমা বেড়েছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৩৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। গাড়ি দুটি, একটির দাম ৭৪ লাখ টাকা, অপরটির দাম ৭৫ লাখ টাকা। ১০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে, যার মূল্য ১০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ১০ ভরি স্বর্ণ যার মূল্য ছিল ১ লাখ টাকা। রাজধানীর মিরপুর আবসিকে দুটি ফ্ল্যাট আছে। যার মূল্য ৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। মিরপুরে ৪ কাঠা জমির মূল্য ৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা, পূর্বাচলে ২০ কাঠা জমির মূল্য ৪০ লাখ টাকা।
ঢাকা-২০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেনজীর আহমদের পেশা মূলত ব্যবসা। তিনি ব্যবসা থেকে বছরে আয় করেন ৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে এ খাতে তার নিজ নামে আয় ছিল ১৭ লাখ টাকা ও তার ওপর নির্ভরশীলদের নামে আয় ছিল ৬ লাখ টাকা। গত পাঁচ বছরে ব্যবসা থেকে নিজের আয় বেড়েছে প্রায় ২৯ গুণ। তার কাছে এবার কোনো নগদ টাকা নেই। ২০১৮ সালে নিজ নামে ছিল ৮৯ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ছিল ৩৩ লাখ টাকা, তার ওপর নির্ভরশীলদের নামে নগদ অর্থ ছিল ৪৯ লাখ টাকা। এবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে জমা ১ কোটি ৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। নির্ভরশীলদের নামে ২২ লাখ টাকা। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে নিজ নামে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি টাকা ও নির্ভরশীলদের নামে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। স্ত্রীর নামে আছে ৫ তোলা স্বর্ণ, যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ হাজার টাকা।
২০১৮ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে জমা ছিল ৬৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ৩ লাখ টাকা। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল নিজ নামে ১২ লাখ টাকা। ওই সময়ে নিজের নামে স্বর্ণ ছিল ১৫ তোলা, যার মূল্য দেখানো হয় ৯৪ হাজার টাকা। একই সময়ে স্ত্রীর নামে স্বর্ন ছিল ৪৫ তোলা। যার মূল্য দেখানো হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
নিজের নামে এবার ৩৪৫ শতাংশ কৃষি জমি মূল্য ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ১০ কাঠা অকৃষি জমি মূল্য ৪০ লাখ টাকা। চারটি ফ্ল্যাটের মূল্য ১২ কোটি টাকা। নিজের নামে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণ আছে। স্ত্রীর নামে কোনো ঋণ নেই। এই প্রার্থীর নামে থাকা ঋণ সমন্বয় করলে তার চেয়ে স্ত্রীই ধনী বেশি।