দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন ছাড়ে খুশি নয় বর্তমান সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪-দলীয় জোট শরিকরা। এ বছর জাতীয় পার্টিকে ২৬ এবং জোট শরিকদের গতকাল পর্যন্ত সাতটি আসন ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়ে কেউ খুশি নয়। জাতীয় পার্টি চায় আরও আসন। ১৪-দলীয় জোট শরিকরা চায় আসন বেশির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রয়েছেন, দল থেকে চাপ প্রয়োগ করে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার। এদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি কৌশল হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বসাতে চায় না। সে কারণে নৌকায় চড়ার টিকিট পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে থাকায় ‘নৌকা ঘাটে ভেড়ানোর সংশয়ে’ ভুগছেন তারা। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা ও জোটের শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব পাওয়া গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে শরিকদের ১৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হলেও এবার তা কমিয়ে সাত করা হয়েছে। নৌকায় চড়ে এমপি হয়ে বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা বিকল্পধারা ও তরিকত ফেডারেশনকে ছাড় দেয়নি ক্ষমতাসীন দল। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনের এমপি। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান দাবি করেছিলেন তাঁকেই নৌকা দেওয়া হবে। এ আসনে নৌকা পেতে চান তিন মাস আগে নিবন্ধন পাওয়া সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেছেন সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ। প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেছেন তাঁরা। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আজ (গতকাল) মহান বিজয় দিবস। শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। এ ছাড়া নির্বাচন বিষয়ে কিছু কথা হয়েছে।’ জানা গেছে, ছেড়ে দেওয়া সাত আসনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে তিনটি করে এবং জাতীয় পার্টি-জেপিকে একটি। শেষ পর্যন্ত তরিকত ফেডারেশনকেও ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে প্রথমে বরিশাল-৩ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তাঁর আসন পরিবর্তন করে বরিশাল-২ দেওয়া হয়েছে। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে কুষ্টিয়া-২, দলের নেতা রেজাউল করিম তানসেনকে বগুড়া-৪ এবং মোশাররফ হোসেনকে লক্ষ্মীপুর-৪ দেওয়া হয়েছে। জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ফেনী-১ আসনে এবার ছাড় পাচ্ছেন না।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২, বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাকে রাজশাহী-২ ও মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে এবারও সাতক্ষীরা-১ আসন দেওয়া হয়েছে। জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দেওয়া হয়েছে তাঁর পিরোজপুর-২ আসন। গত সংসদ নির্বাচনে দলটিকে বরিশাল ও সাতক্ষীরার একটি করে আসনের পাশাপাশি দেওয়া হয় বরিশাল-৩ ও ঠাকুরগাঁও-৩ আসন। তবে তারা সুবিধা করতে পারেনি। এবার আর সেগুলো তাদের দেওয়া হয়নি। জাসদকে গতবার বগুড়া-৪, কুষ্টিয়া-২-এর পাশাপাশি দেওয়া হয় ফেনী-১ ও চট্টগ্রাম-৮ আসন। তরিকত ফেডারেশনকে দেওয়া হয় লক্ষ্মীপুর-১ ও চট্টগ্রাম-২ আসন। জেপিকে দেওয়া হয় পিরোজপুর-২-এর পাশাপাশি কুড়িগ্রাম-৪। ১৪-দলীয় জোটে না থাকলেও নির্বাচনি জোটে বিকল্পধারা পায় মুন্সীগঞ্জ-১ ও লক্ষ্মীপুর-৪ আসন। এদিকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও এককভাবে ভোট করতে ভয় পায়। সে কারণে আসন সমঝোতায় গেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মোট ছয় দফা বৈঠক হয়েছে। গতকালও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক হয় জাতীয় পার্টির নেতাদের। এবার ২৬টি আসন ছাড় দেওয়া হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে। সেখানে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী রাখছে না। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে তাদেরও আপত্তি রয়েছে।
আসন ভাগাভাগি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে ৫০টি আসন চেয়ে আসছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ২৬টির বেশি দিতে রাজি হয়নি। ২৬ আসনে ছাড় দেওয়া হলেও এতে জাতীয় পার্টি সন্তুষ্ট নয় বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যাশা আরও বেশি।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেছেন, ‘বৈঠকে নানা বিষয়ে আলোচনা চলছে, সেখানে আসনের বিষয়টি উঠে আসছে। এর বেশি বলা যাবে না।’ এ বৈঠককে প্রেমের উপমা দিয়ে তিনি বলেন, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমের চিঠি লিখব, এটা কি বাবা-মাকে প্রথমে বলা যায়? আত্মীয়স্বজনকে বলা যায়? বলা যায় না। পরে যখন হয়ে যায়, তখন বলা যায়।’
এদিকে গতকাল জাতীয় পার্টির এক কো-চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের চাহিদা অনুযায়ী আসন দেওয়া হয়নি। আবার যদি আসনগুলোয় নৌকার প্রার্থী অথবা তাদের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকেন তাহলে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না।’
এদিকে গত সংসদ নির্বাচনে জোটসঙ্গীদের ১৬টি আসন ছাড় দিলেও এবার ঘোষণা করেছে সাতটি। আওয়ামী লীগের এ ছাড়ে খুশি নয় শরিকরাও। এমন আভাস পাওয়া গেছে জোট শরিকদের মুখে। তারা নৌকা নিয়ে এমপি হয়েছেন। ছিলেন মন্ত্রিসভায়ও। জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জোটের আসনে আওয়ামী লীগের বড় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে, এক হাতে দিয়ে আরেক হাতে সিটটা কেড়ে নেওয়া। আমি আশা করি, জোটনেত্রী শেখ হাসিনা ও জোটের সমন্বয়ক; তাঁরা বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আওয়ামী লীগ নৌকা দিল, আবার সেখানে তাদের দলের প্রার্থীও থাকল, এর মানে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ বনাম জাসদ, আওয়ামী লীগ বনাম ওয়ার্কার্স পার্টি বা আওয়ামী লীগ বনাম তরিকত ফেডারেশন।’
চট্টগ্রাম-২ আসনে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওই আসনের বর্তমান এমপি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘আমি নৌকা পেয়েছি, সেটা আগেই নিশ্চিত করা হয়েছে।’ সুপ্রিম পার্টি সম্পর্কে বলেন, ‘তিন মাস আগে নিবন্ধন পেয়ে যদি কেউ মনোনয়ন পায়, তাহলে রাজনীতির অবস্থান কোথায় যাবে? সুপ্রিম পার্টি তো ১৪-দলীয় জোটে নেই। তারা জোটবদ্ধভাবে ভোট করবে, নৌকা প্রতীক নেবে এমন চিঠিও ইসিতে দেয়নি।’ নজিবুল বশর বলেন, ‘তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কী? ক্যারিয়ার কী? হঠাৎ কেউ এলো, দু-চারটা প্রোগ্রাম করল, বলে দিলেন আছে! এটা দেশের জন্য, আগামী রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।’
জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আসন ভাগাভাগি নিয়ে আমরা মোটেও সন্তুষ্ট নই। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এর আগেও আমাদের সাতটি, পাঁচটি আসন দেওয়া হয়েছিল। এখন তিনটি দিচ্ছে। এটা যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে মনে হচ্ছে।’ জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেভাবে আসন বণ্টন করল, সেখানে বৈষম্য করা হয়েছে। অনেক দল বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও বৈঠক চেয়েছি। একই সঙ্গে আসন বণ্টন পুনর্বিবেচনার দাবি করেছি।’
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যমতে ধনসম্পদ বেড়েছে এমপিদের, স্ত্রী উপহার পায় ২৫০ ভরি স্বর্ণ