স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন তিনি। এ সময় নৌকায় ভোট চান সরকারপ্রধান। বলেন, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন উপলক্ষে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এই সিলেট অলি-আউলিয়ার দেশ। এদেশ থেকেই আমি আমার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করছি। তিনি বলেন, দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, ভোট দিতে চায়। আমরা আমাদের দলকেও ভোটের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। সবাই দাঁড়াবে, সবাই কাজ করবে। জনগণ যাকে ইচ্ছে বেছে নেবে।
বিকালে সিলেট সরকারি আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। জনসভায় উপস্থিত জনতার কাছ থেকে নৌকায় ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি নেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এই নৌকা নুহ নবীর নৌকা। এই নৌকায় মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে; উন্নয়ন পেয়েছে। আবার আপনারা নৌকায় ভোট দিয়ে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
এ সময় নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধীদের চলমান আন্দোলনের কড়া সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বলেন, বোমাবাজি ও আগুনে পুড়ে মানুষ মারার বিরুদ্ধে সকলকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানুষের জীবন কেড়ে নেবে, মানুষের ভোট দিতে দেবে না, নির্বাচন বন্ধ করবে- এত সাহস কোথা থেকে পায়। লন্ডনে বসে একটা কুলাঙ্গার হুকুম করে- আর কতোগুলো লোক এখানে আগুন নিয়ে খেলে। আগুন নিয়ে খেলতে গেলে আগুনে হাত পোড়ে, এটা তাদের মনে রাখা উচিত। তিনি বলেন, তারা মনে করেছে, আগুন দিলে সরকার পড়ে যাবে- এত সহজ না। আমি শুধু বলতে চাই- আওয়ামী লীগ সরকারে আছে, জনগণের উন্নতি হচ্ছে। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ ও সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমার হারানোর কিছু নেই। বাবা-মা, ভাই সব হারিয়েছি। একটা ছোট বোন আর আমি আছি। নিজের ছোট ছেলে-মেয়েকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে ফিরে এসেছিলাম বাংলাদেশে। কারণ এদেশ স্বাধীন করেছেন আমার বাবা, এ মুক্তিকামী মানুষ দারিদ্র্যে জর্জরিত- এদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। তিনি বলেন, আমরা যখন উন্নয়নের কাজ করছি, তখন তারা (বিএনপি) আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে। কোনো মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকলে এভাবে আগুন দিয়ে মা-শিশুকে হত্যা করা যায় না। মা তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু মা-শিশু কয়লা হয়ে গেছে। তারা আগুন দিয়ে রেল, বাস পোড়াচ্ছে। ২০১৩ সালেও এভাবে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করে তারা। নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে ৫৮২টি স্কুল ও ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়, ৭০টা সরকারি অফিস ও ৬টি ভূমি অফিস ভাঙে, ৩ হাজার ২৫২টি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়, যেখানে যাত্রীবাহী গাড়ি ছিল। মানুষকেও পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলে। ২৯টি রেলগাড়ি, ২টি লঞ্চ পুড়িয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিন হাজারের মতো মানুষকে আগুনে পুড়িয়েছে। যেখানে ৫০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এখনো যারা জীবিত আছে তারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কষ্ট করে জীবনযাপন করছেন। এখনো তারা অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে। অগ্নিসন্ত্রাস করে ২০১৩ সালে তারা নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। ২০১৪ সালে মানুষ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। আমরা সরকারে এসেছি। ২০১৮ সালেও নির্বাচনে এসেও তারা নমিনেশন বাণিজ্য শুরু করে। তাদের নির্বাচন শেষ।
ভবিষ্যতে সিলেটে আরও উন্নয়ন করা হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণের সেবা করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছি। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছি। স্মার্ট বাংলাদেশ হচ্ছে- টেকসই উন্নয়ন, দক্ষ ও অগ্রসর জনগোষ্ঠী, সকলের জন্য সমানভাবে উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট পিপল, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি বাস্তবায়ন করা হবে। সেটার মাধ্যমে বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন বাংলাদেশে গড়ে তুলবো। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে এদেশে ফিরে এসেছিলাম একটি প্রত্যয় ও স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য। সে স্বপ্নটা হলো- দুঃখী বাঙালির মুখে হাসি ফোটানো। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে উন্নত জীবন দেয়া। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ পরবর্তী দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সকলের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তুলে এনেছিলেন। সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন। এর মধ্যদিয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বল্প উন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। দেশের জনগণ তখন একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু সে সময়ে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর বুকভরা বেদনা নিয়ে যেদিন আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম, সেদিনই আমি ঘোষণা করেছিলাম যে- এ বাংলাদেশের মানুষই আমার পরিবার। তাদের জন্য আমি কাজ করবো। সেই লক্ষ্য নিয়েই পথে নেমেছি। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে জাতির পিতার স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়েছি। সেটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ নৌকায় মার্কায় ভোট দিয়ে বার বার আমাদের নির্বাচিত করেছিল বলেই। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যা করে, সংবিধান ও সামরিক আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা কখনো গণমানুষের দিকে তাকায়নি। মানুষের কল্যাণ করেনি। লুটপাট ও জনগণের ভোট চুরিই ছিল তাদের কাজ। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তারা কোনো কাজ করেনি। এটাই ছিল দুর্ভাগ্যের বিষয়। সেই কাজ করলে অনেক আগেই বাংলাদেশ উন্নত হতে পারতো। তারা এসেছিল ক্ষমতাকে ভোগ করতে। তিনি বলেন, ২০০১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলাম। কিন্তু সে সময় আমাদেরকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস। আমেরিকা প্রস্তাব করলো গ্যাস বিক্রি করতে। কারণ আমেরিকার কোম্পানি এখানে গ্যাস উত্তোলন করে। আমি বলেছিলাম আমি গ্যাস বেচবো না। এই গ্যাস আমাদের জনগণের, এই গ্যাস জনগণের কল্যাণে ব্যবহার হবে। জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করে যদি ৫০ বছরের রিজার্ভ রেখে অতিরিক্ত থাকে তাহলে বেচবো। তারা খুব নাখোশ হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ক্ষমতায় আসতে দেবে না। তাছাড়া আমাদের দেশেরও কিছু লোক ছিল। ক্ষমতায় এলো বিএনপি-জামায়াত জোট। বিএনপিকে ক্ষমতায় বসালো ভোট কারচুপির মাধ্যমে। গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েছিল খালেদা জিয়া। সে ক্ষমতায় গেলে গ্যাস বেচবে। সেজন্য তার পিঠে বাহবা দিয়ে ক্ষমতায় বসালো। তার রেজাল্ট কী? জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দুঃশাসন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে দেশে অরাজকতা শুরু করেছে। তারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। নারী-শিশু, পুলিশ, সাংবাদিক সবার ওপর হামলা করছে। আমি মনে করি, মানুষ তাদের কখনো মেনে নেবে না।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক ও নুরুল ইসলাম নাহিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, অভিনেত্রী তারিন জাহান, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রমুখ।
আরো পড়ুন : ঝিনাইদহে দুর্বৃত্তদের হামলায় সাংবাদিক আবু সেলিম মিয়া নিহত