যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ল মন্ত্রীর এপিএস এমদাদ

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আইন-আদালত ক্রাইম নিউজ জনপ্রতিনিধি তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি পুরুষ প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

* মাসোহারার টাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়
* অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ নিয়ন্ত্রণে এমদাদ
* ড্রেজার ও বালু ব্যবসায় এমদাদ
* সড়ক ও পরিবহনে চাঁদাবাজি
* সীমানা পিলার সরিয়ে নদী দখল

বিশেষ প্রতিবেদক : যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। এক যুগের বেশি সময় ধরে মন্ত্রীর এপিএস থাকাকালীন দেশের নানা স্থানে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। রাজধানীতে নামে বেনামে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। শুরু করেছেন ড্রেজার ব্যবসা, বিনিয়োগ করেছেন আবাসন ব্যবসায়। গোলাম দস্তগীর গাজীর নির্বাচনি এলাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমি দখল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মাদক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। কখনো তিনি মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর। তাকে টাকা না দিলে এলাকায় নিরাপদে ব্যবসা করা যায় না। টাকা দিলে অবৈধ ব্যবসাও হয়ে যায় বৈধ। চাঁদা না দিলে গাড়ি চলে না, বন্ধ থাকে কলকারখানার মেশিন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রূপগঞ্জের বালু ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদকের সব ব্যবসাই তার নিয়ন্ত্রণে। এলাকার প্রত্যেকটি চিহ্নিত সন্ত্রাসীর সঙ্গে তার ছবি রয়েছে ফেসবুকে। সন্ত্রাসীরাও তাদের ক্ষমতা দেখাতে মন্ত্রী ও এমদাদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিচ্ছে।

মাসোহারার টাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড় : ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সহকারী একান্ত সচিবদের (এপিএস) সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয়। ষষ্ঠ গ্রেড অনুযায়ী, একজন এপিএস সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ হাজার ১০ টাকা বেতন গ্রহণ করতে পারেন। সর্বোচ্চ বেতনের হিসাবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) এমদাদুল হক গত ১৩ বছরে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা বেতন উত্তোলন করেছেন। কিন্তু এপিএস এমদাদুল হক এই সামান্য বেতনে রাজধানীর ঢাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর আবাসিক এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, দক্ষিণ বনশ্রী জামে মসজিদ ৪-এর সঙ্গে লাগোয়া উঁচু দেয়াল ঘেরা ভবনটি এমদাদুল হকের। তথ্য বলছে, কে ব্লকের ১৩/৩ নম্বর রোডের ৩০/বি-৩০/সি বাড়িটি এমদাদের। বাড়িটির গেটে লেখা ছিল- এ ভবনটির দায়িত্বে রয়েছেন এমদাদুল হকের গাড়ি চালক রাজ্জাক। এমদাদের সাবেক কেয়ারটেকার সাইফুল বলেন, দক্ষিণ বনশ্রীর বাড়িটি ছাড়া বাসাবোতে আরও দুটি বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাড়ি ১০ তলা। ১০ তলা ভবনটিতে শুধু এমদাদেরই রয়েছে আটটি ফ্ল্যাট। ছয় তলা ভবনে রয়েছে আরও দুটি ফ্ল্যাট। এই সাইফুলের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩৬ নম্বর উত্তর বাসাবোর বেস্ট লিভিং লিমিটেডের বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্ট থাকেন এমদাদ। অ্যাপার্টমেন্টটির নিরাপত্তারক্ষী জানান, ওই অ্যাপার্টমেন্টে এমদাদের ফ্ল্যাট রয়েছে দুটি। তিনি থাকেন পঞ্চম তলায়। স্থানীয়রা বলছেন, বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ভবনেই পাওয়া যায় এমদাদুল হকের সরকারি স্টিকারযুক্ত গাড়িটি। সূত্র বলছে, আবাসন ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছেন এমদাদ। রিমঝিম আবাসনের ১৫ শতাংশ শেয়ার এমদাদের নামে রয়েছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকেও নামে বেনামে প্লট বুঝে নেন তিনি।

অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ নিয়ন্ত্রণে এমদাদ : রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের বিতরণ লাইন থেকে নিম্নমানের পাইপ টেনে সেখান থেকে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ দিয়েছেন এমদাদ। এ সংযোগ দিতে এমদাদ তিতাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ প্রত্যেকটি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। অবৈধ সংযোগের ফলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তবে আঙুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছেন এমদাদ। তথ্য সূত্র বলছে, রূপগঞ্জে এমদাদের ব্যবস্থাপনায় প্রায় দেড় লাখ আবাসিক ও ব্যাণিজিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারাবো বেড়িবাঁধ, মোগরাকুল, বরাবো, খাদুন, মৈকুলী, খিদিরপুর, নয়াপাড়া, বড়ভিটা, আরাফাত নগরসহ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশপাশের অধিকাংশ ভবন ও কারখানায় এ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রত্যেকটি আবাসিক সংযোগে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা এককালীন দিতে হয়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে আবারও কিছু টাকা দিলে পুনরায় সংযোগ পাওয়া যায়। তবে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের চাপ বুঝে সর্বনিম্ন ২ থেকে ১৫ লাখ টাকাও দিতে হয়। তারাবো পৌরসভার বাসিন্দা হাসানুর রহমান বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ও তিতাসের সমন্বয়ে কয়েক মাস পর পর অভিযান পরিচালনা করা হয়, অবৈধ সংযোগ বিছিন্ন করা হয়। প্রশাসন চলে যাওয়ার পর পুনরায় সংযোগ দিয়ে যায়। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা না থাকলে অবৈধ সংযোগ প্রদান সম্ভব হতো না।

কারা অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রীর লোক ছাড়া কারা সংযোগ দিবে। আমি কারও নাম বলতে পারব না। পরে ক্ষতি হবে।

ড্রেজার ও বালু ব্যবসায় এমদাদ : মন্ত্রীর এপিএস হওয়ায় রূপগঞ্জের স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছে এমদাদের। ধীরে ধীরে রূপগঞ্জের ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে নেয় সে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জের যুবলীগের সভাপতি কাউসারের তত্ত্বাবধায়নে দুটি ড্রেজার পরিচালিত হয়। এ দুইটি ড্রেজার থেকে বর্তমানে ভোলাবো, কুতুবপুর, মোচারতালুক মৌজায় রিমঝিম আবাসনে বালু ভরাটের কাজ চলছে। এমদাদের দাপটের কারণে হাই কোর্টে রিট করেও এ বালু ভরাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সাধারণ জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ড্রেজারে আগুন লাগিয়ে দেন। বর্তমানে তাদের অধিকাংশ বাড়ি ছাড়া। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সংবাদ চর্চার সম্পাদক মুন্না খান ও রূপগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোমেন ও সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেনের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউনে। কাঞ্চন পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুন্নাহারের নামে এমদাদের ড্রেজার চলছে আমেরিকান সিটিতে ও ইস্টউড সিটিতে একটি ড্রেজার চলছে এমদাদের। এ ছাড়া রূপগঞ্জের যত ড্রেজার রয়েছে তার থেকে উত্তোলিত বালুর দামের ৫ শতাংশ এমদাদকে দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এটার ভাগ আরও ওপরে পৌঁছায়।

সড়ক ও পরিবহনে চাঁদাবাজি : অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভুলতা গাউসিয়ার ফুটপাতে ৪ শতাধিক দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা তোলে এমদাদের নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাহিনী। চাঁদা না দিলে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করে সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া রূপগঞ্জের প্রত্যেকটি বাজার থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে সন্ত্রাসীরা। এর একটি অংশ যা এমদাদের পকেটে। এ ছাড়া সিলেট, গাজীপুর, মদনপুর ও ঢাকার সংযোগ সড়কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে এমদাদ বাহিনী। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি সর্বনিম্ন অটো ৫০ টাকা সর্বোচ্চ ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জ স্ট্যান্ডে সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা ও ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কার রয়েছে যথাক্রমে প্রায় ২৭০টি, ২৫০টি ও ৮০টি। প্রতিটি সিএনজি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা, লেগুনাতে ৬০ টাকা, প্রাইভেট কারে ১০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া মাসিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা এককালীন চাঁদাও দিতে হয়।

সীমানা পিলার সরিয়ে নদী দখল : এমদাদের ছত্রছায়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলার সরিয়ে ভূমি দখল করছেন সন্ত্রাসীরা। তথ্য সূত্র বলছে, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সেতুর উভয় পাশের নদীর তীর দখল করে নিচ্ছে এমদাদ ও তার বাহিনী। রূপগঞ্জের মঠের ঘাট, দড়িকান্দি, বানিয়াদি, আতলাশপুর, হাটাব জেলেপাড়া, ইছাখালি, পাড়াগাঁও, বড়আলু, পূর্বগ্রাম, চনপাড়া, রূপসী, গন্ধবপুরের নদীর দুই পাশের জমি দখল করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, আফজাল ফুড, এনডিই রেডিমিক্স, কেপিসি ও রংধনু গ্রুপের দখলে আছে জমিগুলো।

আরো পড়ুন : ব্যালট পেপার পৌঁছল নেত্রকোনায়

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *