নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে ‘নির্বাচনী অর্থ’ নিয়ে। ক্ষুব্ধ প্রার্থীরা বলছেন, চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু তাদের নির্বাচনী খরচ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও দেননি। প্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করছেন, এ খাতে সরকারের কাছ থেকে তারা অর্থ নিয়েছেন। তবে তাদের এ দাবির বিষয়ে কেউ কোনো তথ্য দিতে চান না। রোববার ঢাকায় আয়োজিত এক সভায় পরাজিত প্রার্থীরা নির্বাচনী অর্থ নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেয়ার পর এখন দলের নেতাকর্মীদের মাঝে বিষয়টি আলোচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর বনানীস্থ চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের থেকে নেতাকর্মীদের সংখ্যা খুবই কম। রোববার রাতে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহ ইয়া চৌধুরীকে বহিষ্কার করে দল। এর আগে সাবেক মন্ত্রী ও কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
নির্বাচনী অর্থের বিষয়ে জানতে চাইলে একজন পরাজিত প্রার্থী বলেন, সারাজীবন জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেছি। এখন কথা বলতেও ভয় হচ্ছে। তিনি নির্বাচনের আগের সময়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, মহাসচিব তো ফোন ধরেন না।
অনেক কষ্টে কথা হলো একদিন। তিনি বললেন, তুমি নির্বাচনের কাজ শুরু করো। টাকা পেয়েছি, তুমি পেয়ে যাবা। আমি পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভালো এমাউন্টই পাবা, নির্বাচন চালিয়ে নিতে পারবা। এরপর আমার সঞ্চিত ৫ লাখ টাকা দিয়ে নির্বাচনের কাজ শুরু করি। এরপর আর কোনো টাকার দেখা নাই। ফোনও ধরেন না। যেহেতু নির্বাচনে গিয়েছি পিছপাও হওয়া যায় না। তাই ধার করে নির্বাচন করতে হয়েছে। এই নির্বাচনের জন্য আমার এখন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে।
তিনি বলেন, আমিতো আগ বাড়িয়ে কিছু বলছি না। মহাসচিব আমাকে নিজে বলেছেন, টাকা পেয়েছেন দিয়ে দেবেন। তিনি আমাকে স্পষ্ট করে বলেছেন, এমাউন্ট অল্প কিন্তু নির্বাচনের কাজ হয়ে যাবে। তিনি টাকা পেয়েছেন জন্যই তো বলেছেন। আমি ১০ টাকাও পাই নাই। টাকা যে দল পেয়েছে তার একটা বড় প্রমাণ হাইব্রিড নেতারা ঠিকই টাকা পেয়েছেন। রেজাউল নিজে (প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া) তার কর্মীদের এই বিষয়টি বলেছেন। তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই রেজাউলরাই জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করবে। তারা ফিরোজ রশীদ, বাবলা, সেন্টু, খোকা ভাইদের কথা শোনেন না।
রোববার পরাজিত প্রার্থীদের আলোচনা সভায় ভাগের টাকার প্রসঙ্গ টেনে উত্তপ্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ-৬ থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া ভৈরব উপজেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল কাদের সোহেল। তিনি গতকাল বলেন, জিএম কাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলোচনা সভায় অনেকেই রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দল থেকে বহিষ্কার করাতো কোনো সমাধান নয়। বহিষ্কার করতে হলে মঞ্চে থাকা সকলকেই করতো। ওনারা এমপি হয়েছেন, ফুলের মালা গলায় নিয়েছেন। সরকারের কাছে টাকা নিয়েছেন। আর আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করেছি। বহিষ্কার না করে আমাদের ডাকা উচিত ছিল, আলোচনা করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, টাকা পেয়েছেন এটার প্রমাণ নাই। তবে আমরা জানি ছোট দলগুলোও নির্বাচনের জন্য টাকা পাইছে। আমাকে একজন সিনিয়র নেতা ফোন দিয়ে বললেন- আমার নামে টাকা উঠানো হয়েছে আমি পেয়েছি কীনা? তার মানে টাকা পাইছে। কাকরাইল পার্টি অফিসে রুবেল ভাই (মানিকগঞ্জ-১ থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করা সমঝোতার আসনের প্রার্থী জহিরুল আলম রুবেল) অকপটেই স্বীকার করলেন তিনি ২৫ লাখ টাকা পার্টি থেকে পেয়েছেন। জাতীয় পার্টি যতবারই নির্বাচনে আসছে টাকা পেয়েছে। তিনি বলেন, ইমরান খান, মির্জা ফখরুল সাহেব যদি জেলে যেতে পারেন। তাহলে জিএম কাদেরের এত কিসের ভয়? এরশাদ সাহেবকে তো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে নির্বাচনে নিয়ে গেছে। তিনিতো বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা। ওনাকেতো ধরেও নিয়ে যায় নাই, মারধরও করা হয় নাই। এই ভয় নিয়ে রাজনীতি না করে পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত।
শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ইয়াহ ইয়া চৌধুরীর বহিষ্কার করা প্রসঙ্গে বলেন, তারা জনসম্মুখে বক্তব্য দিয়েছেন। একটা সংগঠনের নেতা হয়ে এ ধরনের বক্তব্য পাবলিকলি দেয়া সংগঠন বিরুদ্ধ, অমার্জনীয়। তার জন্য চেয়ারম্যান তাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। দল হিসেবে নির্বাচনের সফলতা-ব্যর্থতার দায় জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের ওপর আসে। সেই দায়ভার নিতেও আমরা রাজি ছিলাম। তার মানে এই না, পাবলিকলি এ ধরনের কথা বলতে হবে।
জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের নির্বাচনের জন্য অর্থ নেয়া এবং দেয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, যারা বলছে, আমরা টাকা পাইছি, টাকা যে পাইছি, এর সাক্ষী-প্রমাণ কী। বললেই হলো টাকা পাইছি। নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এর বাইরে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য আরও কী কী হয়েছিল, সেটা তিনি বলতে চান না।
জিএম কাদের বলেন, নির্বাচনের জন্য কাউকে তো ডেকে আনা হয়নি। তখনই বলা হয়েছিল, পার্টি কোনো আর্থিক সহযোগিতা করতে পারবে না। যাদের আগ্রহ ছিল, তারা নির্বাচন করেছেন। এখন এসব করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে।
আরো পড়ুন : সকল মন্ত্রণালয়কে ইশতেহার বাস্তবায়নের তাগিদ দিলেন প্রধানমন্ত্রী