রাজধানীর মোড়ে মোড়ে সোর্সের নামে পরিবহনে পুলিশের চাঁদাবাজি

অনুসন্ধানী আইন-আদালত ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ দুর্নীতি প্রচ্ছদ হ্যালোআড্ডা

অভিযান চলছে গাড়ি থামান। খামার বাড়ি মোড়ে আয়াত পরিবহনের একটি গাড়ি মোড় ঘুরতে সামনে পুলিশের জ্যাকেট পরা এক সদস্য। গাড়ির চালক আসলামের কাছে অভিযানের কথা বলে এভাবেই গাড়িটি থামিয়ে দেন। কিসের অভিযান চলছে? যাত্রীরা জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চালকের জানালার পাশ থেকে পুলিশ সদস্য পালিয়ে যায়। এ সময় মাঝ বয়সী এক সোর্স এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। পরে ২শ’ টাকা চাঁদা দেয়ার পর যায়। সোর্স এর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এবং ছবি তোলার সময় দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ বিষয়ে কথা হয় আয়াত পরিবহন এর চালক আসলামের। তিনি বলেন, গাড়িটি পোস্তগোলা থেকে মিরপুর-১ চিড়িয়াখানা পর্যন্ত যাত্রী বহন করে। পুলিশের এই চাঁদাবাজির শিকার তারা বিভিন্ন স্পটে প্রতিনিয়তই হয়ে থাকে।

পুলিশের বেতনভুক্ত নিজর্স্ব সোর্স রয়েছে। যারা পুলিশের হয়ে এই চাঁদার টাকা তোলেন। এবং নির্দিষ্ট একটি ভাগ পান তারা। পুলিশ সরাসরি টাকা তোলেন না। এই চালক বলেন, গাড়িতে যাত্রী বেশি থাকলে কম টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর যাত্রী কম থাকলে বেশি টাকা দিতে হয়। কেন? জানতে চাইলে জবাবে চালক বলেন, যাত্রী বেশি থাকলে তারা গাড়ি থামিয়ে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করেন। যে কারণে ভরা গাড়ি থাকলে ১ থেকে ২শ’ টাকা নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয় পুলিশ। আর গাড়িতে যাত্রী কম থাকলে ৫শ’ টাকার কম কোনোভাবেই নেয় না পুলিশের সোর্স। কারণ তখন যাত্রীরা ভয়ে প্রতিবাদ করে না। চালক- হেলপার দুজনেই অসহায়।

একই চিত্র দেখা গেছে মিরপুর শাহআলীর মাজার হয়ে গাবতলী মোড়ে। ৮ নম্বর গাড়ির চালক দুলাল বলেন, যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের অনেককেই তল্লাশির নামে ইয়াবা ও গাঁজা ধরিয়ে দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এরকম ঘটনা অহরহ। যাওয়া-আসা দু’বারই পুলিশের সোর্সকে টাকা দিতে হয়। গাবতলীতে পুলিশের বেতনভুক্ত বড় একটি সোর্স সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা হাতে লাঠি নিয়ে ঘোরে। টাকা দিতে না চাইলে চালক-হেলপারদের পেটায় এবং পুলিশের নির্দেশেই এটা করেন তারা। বাধ্য হয়ে তাদের টাকা দিতে হয়। ভরা গাড়িতে যাত্রীরা প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। যাত্রীদেরকেও তারা তেড়ে আসে। সম্প্রতি এক যাত্রী চাঁদার টাকার বিষয়ে প্রতিবাদ করলে তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পালিয়ে যায় সোর্স।

একই চিত্র রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতেও। সেখানে সোর্সের পাশাপাশি পুলিশও চাঁদার টাকার জন্য গাড়ি আটকে দেয়। এ সময় চাঁদা চাওয়া পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নেমপ্লেট খুলে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সোর্স ব্যবহার করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে পুলিশ এবং তাদের সোর্স এমনটি জানা গেছে। রাজধানীর গাবতলী, খামারবাড়ী, মিরপুর-১, পোস্তগোলা, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েসহ বিভিন্নস্থানে সোর্সের নামে এমন চাঁদাবাজি চলে থাকে। নাম না প্রকাশের শর্তে খামারবাড়ীতে ডিউটিরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, সব পুলিশ সদস্য খারাপ হয় না। ১০ জনের মধ্যে একজন খারাপ পথ বেছে নেয়। এখানে অনেক পুলিশ সদস্য আছেন যারা আমাদের তুলনায় পদ-পদবীতে ছোট হলেও ঢাকায় তাদের বাড়ি গাড়ি রয়েছে। আমরা যে টাকা বেতন পাই সেটা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এসব অসাধু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বাসচালক এবং মালিকরা কেন কোনো পদক্ষেপ নেয় না প্রশ্ন করে তিনি বলেন, তাদেরও সমস্যা আছে। হয়তো গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। তাই বাধ্য হয়ে তারাও পুলিশকে টাকা দেয়।

পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করা হাসান এর সঙ্গে কথা হয়। কীভাবে সোর্স হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে ভাঙ্গারির দোকানে কাজ করতাম। এরপর বাসের হেলপারি শুরু করি। পরে দেখি হেলপারি করে যে টাকা পাই তার থেকে এই কাজে টাকা বেশি। একপর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ি। পরে বিভিন্নস্থানে চুরি করতাম। এক সময় এসে অসুস্থ হয়ে যাই। পরবর্তীতে এক বড় ভাই এর মাধ্যমে পুলিশের ইনফর্মার বা সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করি। দীর্ঘ ৪ বছর ধরে এই কাজ করছি। বেশিদিন একস্থানে কাজ করি না। কিছুদিন খামারবাড়ী কিছুদিন যাত্রাবাড়ী, গাবতলী এভাবে কাজ করি। একস্থানে কাজ করলে অন্য পুলিশের নজরে পরে যাই। কতো টাকা পান জানতে চাইলে হাসান জানায়, দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করি। ১ হাজার টাকা তুলে দিতে পারলে ২শ’ টাকা পাই। এভাবে ৫ হাজার টাকায় ১ হাজার টাকা পাই। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি গাড়ি থেকে আমাদের সোর্সমানি উঠে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের এডিসি মো. বশির উদ্দিন বলেন, এক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স। আমরা চাকরি করতে এসেছি। সরকার আমাদের বেতন দেয়। সোর্স ব্যবহার করে পুলিশ এভাবে টাকা তুলবে এটা হতে পারে না। আমরা যথাযথ প্রমাণ পেলে এবং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, পুলিশ এর সোর্স ব্যবহার করে টাকা তোলা এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। প্রায়ই শুনে থাকি। তবে ভুক্তভোগী চালক-হেলপার বা অন্য কেউ যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন সেক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আরো পড়ুন : সরকারের সব সব শক্তিকে আমরা পরাভূত করবো

 

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *