জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পুরনো মামলায় শুরু হয়েছিল বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাজা দেয়ার হিড়িক। গত পাঁচ মাসে শতাধিক মামলায় ১ হাজার ৬৮৭ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে রয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাও। অনেককে একাধিক মামলায় ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই রয়েছেন কারাগারে। কেউ কেউ রয়েছেন কারাগারের বাইরে। নির্বাচনের আগে কৌশলী অবস্থানে ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত এসব নেতা। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও এখনো আড়ালে রয়েছেন। সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বিষয়ে দলের তরফে কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও শিগগিরই আত্মসমর্পণ করছেন না তারা। আরও কিছুদিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন।
পাশাপাশি বিরোধী নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরকার কী আচরণ করে সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।
সাজাপ্রাপ্ত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কারাগারে যেসব সাজাপ্রাপ্ত নেতা রয়েছেন তাদের জামিন দিচ্ছেন না আদালত। এখন আত্মসমর্পণ করলে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হবে। তাই এই ঝুঁকি নেবেন না তারা।
বিএনপি নেতাদের মামলার আইনজীবীরা জানান, গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় বিএনপি নেতাদের পুরনো রাজনৈতিক মামলার বিচারের গতি। কারও মামলার শুনানি চলে রাত পর্যন্ত। কারও মামলার শুনানি চলে টানা ১০ দিন। এসব মামলার বাদী-সাক্ষী সবাই ছিল পুলিশ। একতরফা বিচার শেষে দেয়া হয় সাজা। নির্বাচনের পরও অব্যাহত রয়েছে এসব মামলার বিচার কার্যক্রম। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীমসহ অনেকের মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিএনপি’র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, গত বছরের ২৭শে জুলাই থেকে সারা দেশে ২৭ হাজার ৪৯৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৭৫টি। এসব মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১ লাখ ৫ হাজারের বেশি। এ ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪ মামলায় বিএনপি’র ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গত পাঁচ মাসে শতাধিক মামলায় ১ হাজার ৬৮৭ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
তিন মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আত্মসমর্পণ করছি না। গ্রেপ্তার এড়িয়ে কৌশলী অবস্থানে থেকে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবো। এই সরকারের সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো।
৫টি মামলায় ১৩ বছর ৬ মাস সাজা হয়েছে যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন হাসানের। তিনি বলেন, এই সরকার মামলা থাকলেও গ্রেপ্তার করছে, না থাকলেও গ্রেপ্তার করছে। বিএনপি’র চলমান কর্মসূচিকে ঘিরে হাজার হাজার নিরীহ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাই এই অনির্বাচিত সরকারের হাতে আমি আত্মসমর্পণ করবো না। চেষ্টা করবো গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিতে।
গত তিন মাসে ৫টি মামলায় ১৫ বছর তিন মাসের সাজা দেয়া হয়েছে বিএনপি’র স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েলকে। তিনি বলেন, আমার আইনজীবীদের সঙ্গে আগে পরামর্শ করবো। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবো। এ ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। দলীয়ভাবে কি সিদ্ধান্ত হয় সেটিও বিবেচনায় নেবো। তবে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি নেতাদের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেয় সেটি পর্যবেক্ষণ করবো। আদালত যদি কারাগারে থাকা সাজাপ্রাপ্তদের নেতাদের জামিন দেয় তাহলে আত্মসমর্পণ করবো। আর যদি তাদের জামিন না দেয় তাহলে কৌশলী অবস্থানে থাকবো।
৫টি মামলায় ১৬ বছর ৮ মাসের সাজা হয়েছে যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের। তিনি বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশে যদি স্বাভাবিক সরকার থাকতো, আইন যদি আইনের গতিতে চলতো তাহলে আমরা অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতাম। কিন্তু দেশে চলছে একটি অস্বাভাবিক সরকার। অবৈধ সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিচারকরা ফরমায়েশি রায় দিচ্ছেন। আমাদের যেসব মামলায় সাজা দিয়েছে সেগুলোর কোনোটির আইনি ভিত্তি নেই। তারপরও দল কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখবো। তবে এই মুহূর্তে আত্মসমর্পণ করছি না। কারাগারে গেলে বের হতে পারবো না। কৌশলী অবস্থানে থেকেই সরকার পতন আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
একটি মামলায় দুই বছরের সাজা পাওয়া বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসান বলেন, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে হলে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে হবে। কিন্তু হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর সাতক্ষীরার বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। তাই সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেবো।
বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিএনপি নেতাদের অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। মামলায় বিচারের ক্ষেত্রে লিগ্যাল প্রসিডিউর ফলো করা হয়নি। আইন যদি নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে এসব মামলার সাজা আপিলে বাতিল হয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছি- এই সাজা বহাল থাকবে না উচ্চ আদালতে।
সাজা হয়েছে যেসব নেতার: বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, গ্রাম সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, হাবিবুর রশিদ, আকরামুল হাসান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনূস মৃধা, মো. মোহন, হাজী মনির, মোশাররফ হোসেন খোকন, রংপুর জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু ও মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব এডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদ প্রমুখ। এ ছাড়া যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করা একমাত্র মো. শাহজাহান জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করা জাপার একাংশের মহাসচিব ও সাবেক এমপি আহসান হাবিব লিংকনসহ বিএনপি’র আরও ৪ জনকে জামিন দেয়নি আদালত।