চালের বাজার অস্থির হয়েছে মিল মালিকদের কূটকৌশলে

অর্থনীতি ওকে নিউজ স্পেশাল ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ দুর্নীতি প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল শিল্প প্রতিষ্ঠান হ্যালোআড্ডা

সরকারি গুদামে এবার খাদ্যশস্যের নিরাপদ মজুত রয়েছে। পাশাপাশি চলতি মৌসুমে আমনেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে বাজারে চালের সরবরাহও পর্যাপ্ত। মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি বস্তায় থরে থরে সাজানো। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। এরপরও দাম বাড়তি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিল মালিকদের কূটকৌশলে অস্থির হয়েছে চালের বাজার। নির্বাচনের পর মিলপর্যায় থেকে বস্তায় (৫০ কেজি) সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা বাড়ানো হয়। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি বাজারে হুহু করে বাড়ে দাম। প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারেও।

তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকির পর বস্তায় ১০০ টাকা কমেছে। এতে মূল্য কিছুটা কমলেও আগের তুলনায় বাড়তি দরে চাল কিনতে এখনো বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তা।

এদিকে খুচরা বাজারে গরিবের মোটা চাল সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা একদিন আগেও ছিল ৫৬ টাকা। গত বছর একই সময় এ মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাল সব শ্রেণির ভোক্তার অপরিহার্য খাবার। ফলে পণ্যটির দাম বাড়লে সব শ্রেণির ক্রেতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তবে এক কেজি মোটা চাল ৫৫ টাকা হওয়ায় নিম্ন-আয়ের মানুষের ভোগান্তি বহুগুণ বেড়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে (১৮ জানুয়ারি), সরকারের মোট ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৯৭১ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪৮ টন, গম ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৮৯ টন এবং ধান ১৬ হাজার ৬৯৯ টন মজুত রয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের খাদ্যশস্যের নিরাপদ মজুত পর্যাপ্ত রয়েছে।

অন্যদিকে আমন মৌসুমে দেশে মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ চাল সংগ্রহ করা হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। বাকি জমির ধান উত্তোলন করা হলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে ধানের আশানুরূপ বাম্পার ফলন হয়েছে। এই ধানের চাল বাজারেও আসতে শুরু করেছে।

অধিদপ্তর সূত্র আরও জানায়, গত বছর একই সময় আমন মৌসুমে ৫৯ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তবে আবাদ করা হয় ৫৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। এতে মোট উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ টন চাল, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টন বেশি।

নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরে মিলপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিলপর্যায়ে প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২২০০ টাকা, যা একদিন আগে ২৩০০ টাকা ছিল। দুই সপ্তাহ আগে যা ২১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বস্তা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০-২৩০০, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ২২০০ টাকা। প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০, যা আগে ২৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মিলপর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি জানান, চাহিদামতো অর্ডার দিলেও তারা কম পরিমাণে চাল সরবরাহ করেছে। দেশের সব মিলাররা এক হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নির্বাচনের পরপরই দাম বাড়িয়েছে। তাদের কূটকৌশলে এখনো অস্থির চালের বাজার। তবে সরকার মিল তদারকির পর দাম নামমাত্র কমেছে। সেই চাল এখনো বাজারে না আসায় আগের মতোই প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাত ২৩৫০-২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহ আগে ২২০০ টাকা ছিল। পাশাপাশি বিআর-২৮ জাতের চাল বস্তাপ্রতি হচ্ছে ২৫৫০, যা আগে ছিল ২২০০-২৩০০ টাকা। মিনিকেট বস্তাপ্রতি ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, যা আগে ২৯০০-৩০০০ টাকা ছিল।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মিলাররা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ধান কাটার মৌসুম এলেই তারা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ান। এবারও তাদের কূটকৌশলে সেটাই হয়েছে। এবার আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে, এরপরও দাম ভোক্তা সহনীয় হচ্ছে না। তাই মূল্য কারসাজিতে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়ার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, ডিসেম্বর থেকে ধানের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সব ধরনের ধানের দাম মনপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। নভেম্বরে সরু ধানের মন ছিল ১৪২০, বর্তমানে সেই ধান কিনতে হচ্ছে ১৬৮০ টাকায়। মাঝারি মানের ধান মনপ্রতি বেড়ে ১৩৭০ টাকা হয়েছে। এ কারণে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে মোকামে।

রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণাজাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫২ টাকা। পাশাপাশি প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা, যা আগে ৬৫-৭০ টাকা ছিল। আর কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকা।

এদিকে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার তদারকি শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, মিল মালিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পরই বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা করে কমেছে। পরদিন আরও কমেছে। দু-একদিনের মধ্যেই দাম আগের অবস্থায় চলে আসবে।

তিনি জানান, বাজারে অভিযান পরিচালনা করে অসাধুদের আইনের আওতায় এনে চালের মূল্য সহনীয় করা হচ্ছে। তবে বুধবার খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, হঠাৎ করে অস্থির হয়ে ওঠা চালের বাজার আগামী চার দিনের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরবে। এরপরও দাম আগের মতো সহনীয় হয়নি।

খুলনায় কমেনি দাম : খুলনা ব্যুরো জানায়, আমন মৌসুমের চাল বাজারে এলেও খুলনায় চাল বিক্রি হচ্ছে বেশি দরে। বাজারে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি মূল্যে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। সরকারি কোষাগারে মজুত ও মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে খোলাবাজারে ধান যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তার চাহিদায় বাজারের সংকট দেখা দিয়েছে।

বাজার ঘুরে জানা যায়, রোববার খুলনার বাজারে চাল বিক্রি হয়েছে গড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি দরে। এক সপ্তাহ আগেও এসব চালের দাম ছিল কম। এর মধ্যে ৪২ টাকা মোটা স্বর্ণা ৪৬ টাকা ৫০ পয়সা, ৪৭ টাকার রত্না ৫২ টাকা, ৫৩ টাকার মিনিকেট মানভেদে ৬০ টাকা, ৬৫ টাকার বাসমতী ৭২ টাকা, ৩৮ টাকার ইরি আতপ ৪৩ টাকা এবং ৬২ টাকার নাজিরশাইল ৬৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আরো পড়ুন : যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *