২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অন্তত ৩০০ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের চিহ্নিত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটি বলছে, এরা প্রায় সবাই এখন এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আবার কেউ গ্রেফতার এড়াতে বিদেশে লুকিয়ে আছেন।
সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর দিনাজপুর, নীলফামারী এবং ঢাকার আশপাশে অভিযান চালিয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, চিকিৎসকসহ নয়জনকে আটক করে সিআইডি। এখন পর্যন্ত এ মামলায় চিকিৎসকসহ মোট ৪১ জন আটক হয়েছেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ২০২০ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় আটক ৪১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা জানান, মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় আরও অনেকে নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে ২০১০ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে জাতীয় মেধায় ১১তম স্থান লাভ করেন ডা. ফয়সাল আহমেদ রাসেল। পরে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) ভর্তি হন। এরপর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ডা. ফয়সাল পরে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। তাকে গত ১১ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে সিআইডি।
ডা. তৌফিকুল ইসলাম রকি আগেই গ্রেফতার ডা. জিল্লুর হাসান রনির অন্যতম সহযোগী ছিলেন। তারা দুজনই রংপুর মেডিকেল থেকে পাস করেছেন। সে সুবাদে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রকি বিটস কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। রকি, হাপ্পু ও রনি মিলে অনৈতিক উপায়ে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডা. ইবরার আলমও ডা. জিল্লুর হাসান রনির সহযোগী ছিলেন। ইবরার ২০১৩ ও ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে ডা. রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে তা সরবরাহ করেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া ডা. সাইফুল আলম বাদশা ২০১০ সালে সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে ঢামেকে ভর্তি হন। এরপর প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে তিনি একাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেল ভর্তি করিয়েছেন। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানান, ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেলের মেডিকেল অফিসার ডা. অনিমেষ কুমার কুণ্ডু গ্রেফতার হন। তিনি ২০১৫ সালে ১০ শিক্ষার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্ন পড়িয়েছেন। এর মধ্যে আটজন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। একই দিন গ্রেফতার হন ডা. জাকিয়া ফারইভা ইভানা (৩৫)। তিনি ২০০৬-০৭ সেশনের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় ৬০তম স্থান অর্জন করেন। মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়ে ঢামেকে ভর্তির সুযোগ পান। সাবরিনা নুসরাত রেজা টুসী রংপুর মেডিকেল কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী। ডা. অনিমেষের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে সুযোগ পান তিনি। এ ছাড়া জাকারিয়া আশরাফ ও মৈত্রী সাহা ২০১৫-১৬ সেশনে ঢামেকের শিক্ষার্থী। এ দুজনও অভিযুক্ত ডা. অনিমেষের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে ভর্তির সুযোগ পান। এ ছাড়া ডা. কে এম বশিরুল হক থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জানা যায়, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন মুর্শিদা মুস্তারিন। একই বছর তার যমজ বোন মেহনাজ মুস্তারিন মেধাতালিকায় ২৪তম হয়েছিলেন। ওই শিক্ষাবর্ষে দুজন ভর্তি হন ঢামেকে। তাদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ মোস্তফা কামাল। ডা. ইউনুচ উজ্জামান তারিমের মাধ্যমে দুই বোন ভর্তি হন। এ ছাড়া ফাঁস করা প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ওই বছর মেধাতালিকায় ১২তম হয়েছিলেন শাহনাজ জেসমিন জিনিয়া। তিনিও ঢামেকে ভর্তি হন। একই জালিয়াত চক্রের মাধ্যমে মেডিকেলে মেধাতালিকায় অষ্টম হয়েছিলেন ইয়াংকি চক্রবর্তী। আর মেধাতালিকায় ১১তম হন মুসতাহিন লামিয়া। জানা যায়, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এস এম সানোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তির খোঁজ পায় সিআইডি। দীর্ঘদিন তিনি গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন। পরে বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সানোয়ারের বড় ভাই মোহাম্মদ আবদুস ছালাম। সানোয়ারই প্রথম সিআইডিকে জানান কয়েক বছর ধরে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যেই গ্রেফতার হন জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু ও তার খালাতো ভাই প্রেসের মেশিনম্যান আবদুস সালাম খান, পারভেজ খান, জাকির হোসেন দিপু, সামিউল জাফর সিটু, আলমগীর হোসেন (জসীমের বোনজামাই), শাহজাদি আক্তার মীরা (জসীমের বোন), মোহাইমিনুল ইসলাম, রেদওয়ানুর রহমান শোভন, ইমন খান (সালামের ছেলে), মনিরুল ইসলাম মাহি (সালামের বোনের ছেলে), আলমাস হোসেন ও কাওছার আহমেদ। তারা সবাই বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
আরো পড়ুন : ন্যাটোর মতে দুই দশকের মধ্যেই ইউরোপ তছনছ করবে রাশিয়া