যত অপকর্ম বুড়িগঙ্গার ওপারে ‘আব্বা বাহিনী’র

অনুসন্ধানী আইন-আদালত ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ জনপ্রতিনিধি তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরই ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা তিনি। ছেলেও আওয়ামী লীগের সমর্থক।

বাবা ও ছেলে ব্যবসা করেন; কিন্তু স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতেই হয়। সেটি দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সে কারণে এই বাবা ও তাঁর ছেলেকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন ‘আব্বা বাহিনী’র সদস্যরা।

ঘটনাটি ২০২৩ সালের শেষ ভাগের (ভুক্তভোগীর অনুরোধে সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ করা হলো না)। বাহিনীটির ভয়ে বাবা ও ছেলে মামলাও করেননি। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

কথিত এই আব্বা বাহিনী ‘পরিচালনা’ করেন আরেক বাবা ও তাঁর ছেলে। এলাকা ঢাকার উপকণ্ঠে বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। বাবার নাম বাছের উদ্দিন, যিনি শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর ছেলের নাম আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বি। তিনি ছিলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১২ জানুয়ারি তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

আব্বা বাহিনীর সদস্য প্রায় ৪০ জন। এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জমি দখল, ঝুট, কেব্‌ল টেলিভিশন (ডিশ) ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। কোনোভাবে এসব কাজে কেউ বাধা দিলে তারা হামলা করে, কুপিয়ে জখম করে এবং নির্যাতন কেন্দ্রে (টর্চার সেল) নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তাদের দুটি টর্চার সেল রয়েছে।

বাহিনীটির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে রাজি নন। কারণ, মুখ খুললেই হামলা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার পাওয়া যায় না; বরং ঝামেলায় পড়তে হয়।

আব্বা বাহিনীর সদস্য প্রায় ৪০ জন। এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জমি দখল, ঝুট, কেব্‌ল টেলিভিশন (ডিশ) ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে ১০ জানুয়ারির পর। চাঁদার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ওই দিন সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল নামের নিজেদেরই এক সদস্যকে টর্চার সেলে ছয় ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে খুন করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। নির্মম নির্যাতনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। সমালোচনার মুখে পুলিশ বাছের উদ্দিনের ছেলে আফতাবসহ বাহিনীটির ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। বাছের উদ্দিন এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে যান।

১৭ জানুয়ারি থেকে দুই প্রতিবেদক তিন দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ঘুরে আব্বা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার ১৫ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। শুধু আব্বা বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে এলাকাছাড়া একটি পরিবার তাঁদের পরিচয় প্রকাশে রাজি হয়েছে। কারণ, তাঁরা এখন শুভাঢ্যায় থাকেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শুভাঢ্যার একজন ব্যবসায়ী বলেন, ভিডিও ছড়িয়ে না পড়লে রাসেল খুনের ঘটনায় আব্বা বাহিনীর কিছু হতো না। এখন তাঁদের পক্ষে মানববন্ধন ও মিছিল করানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শুভাঢ্যা এখনো আব্বা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কারণ, বাছেরের ভাই ও আফতাবের চাচা ইকবাল হোসেন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তিনিই আব্বা বাহিনীর প্রশ্রয়দাতা। পুলিশের ওপর কারও আস্থা নেই।

ঢাকার উপকণ্ঠে শুভাঢ্যা

ঢাকার বাবুবাজারের দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পার হলে দেখা যায়, হাতের বাঁ দিকে একটি সড়ক। সেই সড়ক ধরে এক কিলোমিটারের মতো গেলে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের শুরু। শুভাঢ্যা কেরানীগঞ্জের ১২টি ইউনিয়নের একটি। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, শুভাঢ্যায় সোয়া দুই লাখ মানুষের বাস। তবে জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এখন জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে বর্ধিষ্ণু এলাকাটিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি পুরান ঢাকায় কাজ করা নিম্ন আয়ের মানুষেরা থাকেন।

শুভাঢ্যা ইউনিয়নেও অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী ছোট ছোট ডাইং ও পোশাক কারখানা, খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা, নৌযান মেরামতের কারখানা ইত্যাদি রয়েছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক চালুর পর শুভাঢ্যায় আবাসন ব্যবসায়ীরাও জমি কিনছেন।

স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, আব্বা বাহিনী গড়ে উঠতে শুরু করে বছর দশেক আগে। ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ও তাঁর ভাই বাছের (আফতাবের বাবা) বহু আগে থেকেই দলবল নিয়ে চলতেন। সেই দলবলই পরে বাহিনীতে রূপ নেয়। সেটির মূল ব্যক্তি এখন বাছের। মাঠে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তাঁর ছেলে আফতাব। প্রশ্রয়দাতা ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল।

শুরুতে এটি আব্বা বাহিনী নামে পরিচিত ছিল না। নামটি এসেছে সাম্প্রতিককালে। বাহিনীর ‘মাঠের নেতা’ আফতাবকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ‘আব্বা’ বলে ডাকেন। কারণ, তাঁর চাচা ইকবাল হোসেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। নেতাদের মুখের আব্বা ডাকের কারণে আফতাবের বাহিনীর নাম আব্বা বাহিনী হয়েছে।

চর মীরেরবাগ থেকে তেলঘাটের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। সেখানে পারভীন টাওয়ার নামের দোতলা একটি বিপণিবিতান রয়েছে। সেটির নিচতলায় আব্বা বাহিনীর দ্বিতীয় টর্চার সেল। সেখানেই রাসেলকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যার চর মীরেরবাগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের কেনা একটি বাড়ি। এটিকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত ‘আব্বা বাহিনী’। এই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আমির হোসেনকে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আব্বা বাহিনীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বলেন, তিনি বরং শুভাঢ্যাকে সন্ত্রাসমুক্ত করেছেন। তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন, এখনো আছেন।

অবশ্য আব্বা বাহিনী যে দুটি টর্চার সেল পরিচালনা করে, তার একটি চেয়ারম্যানের কেনা একটি বাড়িতে। ওই বাড়ি তত্ত্বাবধান করতেন আমির হোসেন নামের এক ব্যক্তি, যিনি রাসেল খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বাড়িটি শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চর মীরেরবাগ এলাকায় গত সোমবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক কাঠা জমির ওপর টিনের ছাউনির কয়েকটি কক্ষের সেই বাড়ির চারদিকে দেয়াল তোলা। সেই দেয়ালে টাইলসের ওপর চেয়ারম্যান ইকবালের ছবি ছাপানো। বাড়ির ফটকে তালা মারা। পাশের একটি একতলা ভবনের ছাদে উঠে বাড়িটির ছবি তুলতে গেলে একদল লোক এই প্রতিবেদকদের ঘিরে ধরেন। তাঁদের মারমুখী অবস্থানের মধ্যে মুঠোফোন থেকে কিছু ছবি মুছে দিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে হয়।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যার চর মীরেরবাগে ‘আব্বা বাহিনী’র নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের ছবি।

চর মীরেরবাগ থেকে তেলঘাটের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। সেখানে পারভীন টাওয়ার নামের দোতলা একটি বিপণিবিতান রয়েছে। সেটির নিচতলায় আব্বা বাহিনীর দ্বিতীয় টর্চার সেল। সেখানেই রাসেলকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, রাসেল অর্ধমৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁর গা খালি। বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। দুই পাশে চেয়ারে বসে রয়েছেন আব্বা বাহিনীর অন্তত ১৩ সদস্য। সামনে একটি টেবিল ও চেয়ার। চেয়ারে বসা আব্বা বাহিনীর মাঠের নেতা আফতাব।

নিহত রাসেলের বাবা, মা, স্ত্রী ও একটি শিশুসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার বলেন, রাসেলকে মেরে ফেলার পর তাঁরা আব্বা বাহিনীর ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন। গত রোববার তিনি ঢাকার আদালতে গিয়েছিলেন। সেখানেও আব্বা বাহিনীর লোকেরা তাঁকে নজরদারিতে রেখেছিল।

হামলা, নির্যাতনের যত ঘটনা

শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চর খেজুরবাগ এলাকার আলমগীর হোসেন ২০ বছর ধরে ডিশ ব্যবসা করেন। ব্যবসাসংক্রান্ত বিরোধে তিনি ও তাঁর দুই ছেলের ওপর গত বছরের ৩১ মে আব্বা বাহিনী হামলা চালায়। ঘটনাটিতে থানায় হওয়া মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রায় ২৫ জনের একটি দল হামলায় অংশ নেয়। আলমগীরকে রড ও হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন তাঁর ছেলেরাও।

আলমগীর ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর এক স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পরে শুভাঢ্যার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ডেকে নিয়ে মামলা তুলে নিতে বলেন এবং বিষয়টি মীমাংসার নামে ধামাচাপা দেন। তাঁরাও মেনে নিতে বাধ্য হন। মামলা তুলে নেন।

রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আব্বা বাহিনীর সঙ্গে সখ্য রাখার অভিযোগ ছিল।

চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বলেন, তাঁরা দুই পক্ষ আসায় তিনি মীমাংসা করে দিয়েছেন।

২০২৩ সালের শেষের দিকে আব্বা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার আরেক ব্যক্তির স্বজনেরা বলেন, চাঁদার দাবিতে বাহিনীর সদস্যরা ওই ব্যক্তিকে নির্যাতন করে। পরে মিথ্যা অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশ তাঁকে একটি মামলায় আসামি করে আদালতে পাঠায়।

নির্যাতনের আরও কয়েকটি ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে। সবাই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সেটি প্রকাশ করতে দিতে রাজি নন। তাঁদের আশঙ্কা—আব্বা বাহিনী বুঝে ফেলবে এবং তাঁদের আবার নির্যাতন করা হবে। বেশির ভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের দাবি, পুলিশের কাছে গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। উল্টো আব্বা বাহিনীর লোকেরা খবর পেয়ে যেতেন।

পুলিশের দাবি, তাঁদের কাছে এ ধরনের বাহিনীর বিষয়ে কোনো তথ্য আসেনি। সখ্য থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাহিনীটির বিষয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। এখন কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে।

অবশ্য রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আব্বা বাহিনীর সঙ্গে সখ্য রাখার অভিযোগ ছিল। তিনি আফতাবের টর্চার সেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। বসা ছিলেন আফতাবের চেয়ারে।

‘আব্বা বাহিনী’র নির্যাতনে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন ব্যবসায়ী আবিদ হোসেন ও তাঁর পরিবার। ৯ মাস ধরে বাড়িটি তালাবদ্ধ। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চর মীরেরবাগে

পরিবারটি বাড়িছাড়া

শুভাঢ্যার চর মীরেরবাগ এলাকায় এক যুগের বেশি সময় আগে জমি কিনে বাড়ি করেছেন ব্যবসায়ী আবিদ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম। পাঁচ শিশুসন্তান নিয়ে ওই বাড়িতেই থাকতেন তাঁরা।

মরিয়ম বলেন, মাদক বিক্রিতে বাধা এবং চেয়ারম্যানের লোকদের বিরোধিতা করায় গত বছরের এপ্রিলে তাঁদের বাড়িতে হামলা করে লুটপাট চালান আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। তখন তিন দিন তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে তাঁরা এলাকাছাড়া।

মরিয়ম বলেন, ‘অবরুদ্ধ করে রাখার তৃতীয় দিন বাড়ির ফটক ভেঙে হামলাকারীরা ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাট চালান। আমি ভয়ে বাচ্চাদের টয়লেটে লুকিয়ে রেখেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। তবে তাঁদের ১২ ঘণ্টার বেশি সময় তেলঘাট ফাঁড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে আব্বা বাহিনীর লোকজন গিয়ে পুলিশের সামনেই তাঁদের হুমকি দেন। মামলা করতে চাইলেও পুলিশ তা নেয়নি। তিনি দাবি করেন, পরদিন তাঁরা চেয়ারম্যান ইকবালের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। ইকবাল হোসেন তাঁদের এলাকা ছাড়তে বলেন।

চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ওই মহিলা (মরিয়ম) ভালো না। এটা এলাকাবাসীর কোন্দল। এখানে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই।’

অবশ্য শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাদেক হোসেন বলেন, ‘অনেক কিছু বলা যায় না, আবার না বলেও উপায় নেই। এই মেয়েটা (মরিয়ম) সাহসী। মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় নানা অপবাদ দিয়ে তাঁকে এলাকাছাড়া করা হয়।’

চর মীরেরবাগে মরিয়মের বাড়িতে গিয়ে গত সোমবার সেটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। সেখানে যেতেই একদল লোক এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। তাঁরা বলেন, তাঁরাই চেয়ারম্যানের (ইকবাল হোসেন) সঙ্গে কথা বলে বাড়িটিতে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।

অবরুদ্ধ করে রাখার তৃতীয় দিন বাড়ির ফটক ভেঙে হামলাকারীরা ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাট চালান। আমি ভয়ে বাচ্চাদের টয়লেটে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
মরিয়ম

তেলঘাট ফাঁড়িতে যখন মরিয়মের পরিবারকে আব্বা বাহিনীর লোকেরা হুমকি দিচ্ছিলেন, তখন সেখানে দায়িত্বে ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) জিল্লুর রহমান। এখন তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় কর্মরত। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ভালো লোক নন। আর মামলা কেন হয়নি তা ওসি (থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলতে পারবেন।

ওই সময় কেরানীগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন মোহাম্মদ শাহজামান। তিনি এখন গাজীপুরের শ্রীপুর থানার ওসির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, এমন ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটি তিনি মনে করতে পারছেন না।

এদিকে খোঁজখবর নেওয়ার পর পুলিশ পরিবারটিকে বাড়িছাড়া করার ঘটনার তদন্তে সক্রিয় হয়েছে। মরিময় গত মঙ্গলবার রাতে বলেন, পুলিশ এখন ৯ মাস আগের সেই ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিয়েছে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট এলাকার পারভীন টাওয়ার নামে পরিচিত বিপণিবিতান। এই ভবনের নিচতলায় ‘আব্বা বাহিনী’র নির্যাতনকেন্দ্র বা টর্চার সেলে ছয় ঘণ্টা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেলকে।
‘অস্বীকারের উপায় নেই’

তিন দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়নের নয়জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই দুই প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, আব্বা বাহিনীকে তাঁদের এককালীন অথবা একাধিক দফায় ৩ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়েছে। কারও কারও জমিও দখল হয়েছিল। ফেরত পেতে টাকা দিতে হয়েছে।

রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর আফতাব ছাড়াও বাহিনীর সদস্য আলমগীর হোসেন ওরফে ঠান্ডু, মো. শিপন, আমির হোসেন, দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু, মো. রনি, অনিক হাসান ওরফে হিরা, মো. সজীব, ফিরোজ, রাজীব আহমেদ, মাহফুজুর রহমান ও রতন শেখ গ্রেপ্তার হয়েছেন। রিমান্ড শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে আফতাবসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বাহিনীটির সক্রিয় সদস্য হান্নান, লাক্কা, ফাহিম, অভি, সাজ্জাদ, শাহীন, রানা, বাপ্পী, জুম্মন, রাকিব, সালাউদ্দিন, মাইকেল ও হিরন। তাঁরা এখন আত্মগোপনে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেরানীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, কেউ যদি অপরাধে জড়িত হন, তাহলে আওয়ামী লীগ করলেও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এই অপরাধী চক্রটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, সেটি অস্বীকার করার উপায়ও নেই।

অবশ্য ভুক্তভোগীদের একজন বলেছেন, আব্বা বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে তিনি পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেও গিয়েছিলেন। কেউ সহায়তা করেনি।

সংবাদের পুরো কৃতিত্ব দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার

আরো পড়ুন : চলছে সংসদে বিরোধী দলের আসন বিন্যাস

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *