জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে ইলেকট্রনিক পণ্য। সেই পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্যই এখন মাথা ব্যথার কারণ। বাংলাদেশে বছরে সৃষ্টি হচ্ছে ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য, যা হুমকিতে ফেলেছে দেশের জীববৈচিত্র্যকে। তথ্য বলছে, ই-বর্জ্যে সিসা, পারদ, তামা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিকসহ নানা ক্ষতিকর ভারীর পাশাপাশি রয়েছে সোনা, রুপাসহ নানা মূল্যবান ধাতু। ১ কোটি টন ই-বর্জ্য রিসাইকেল করে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। কিন্তু এগুলো সংগ্রহ ও রিসাইকেলের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে না ওঠায় তা ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। ফলে শুধু সম্পদই নষ্ট হচ্ছে না, ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও রাসায়নিক দূষিত করছে মাটি, পানি ও বায়ু। ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর রেডিয়েশন। বাড়াচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারসহ কিডনি, যকৃত, স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপি- ও মস্তিষ্কের নানা রোগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি কমাতে সরকার ২০২১ সালে ‘ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা’ তৈরি করলেও দুই বছরে তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ বর্জ্যরে শেষ গন্তব্য আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ড। তিন পাশে নদীবেষ্টিত ল্যান্ডফিল্ডে জৈব বর্জ্যরে সঙ্গে প্লাস্টিক ও ই-বর্জ্যও জমা হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, ল্যান্ডফিল্ডের বর্জ্য থেকে নিষ্কাশিত বিষাক্ত পানি সরাসরি মিশছে নদীর পানিতে। ই-বর্জ্যরে ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা করছেন বুয়েটের রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক হৃদয় রায়। তিনি বলেন, আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ড থেকে সংগৃহীত পানির স্যাম্পলে লেডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৮.৯৪ পিপিএম, যা নির্ধারিত গাইডলাইন থেকে প্রায় ৯০ গুণ বেশি। ক্যাডমিয়াম ও পারদের উপস্থিতিও নির্ধারিত গাইডলাইন থেকে অনেক বেশি। এই পানি নদীতে পড়লে তা মানুষসহ নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। ভূগর্ভস্থ পানিতে মেশার বড় সুযোগ রয়েছে, যার পরিণতি হবে মারাত্মক।
তথ্যানুযায়ী, দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার গত এক দশকে তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ কোটি টাকায়। এসব ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে বছরে সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য। গত জুনে এক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আখতার হোসেন জানান, প্রতি বছর দেশে নষ্ট হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২টি টেলিভিশন।
এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন ই-বর্জ্য। নষ্ট বা মডেল পরিবর্তন করতে গিয়ে বাতিল হচ্ছে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন। শুধু স্মার্ট ডিভাইস থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। প্রতিদিনই বাতিলের খাতায় যুক্ত হচ্ছে ফ্রিজ, ওভেন, ব্যাটারি, কম্পিউটার, সোলার প্যানেল, চার্জারসহ অগণিত ইলেকট্রনিক পণ্য। প্রতি বছর এই বর্জ্য বাড়ছে ৩০ শতাংশ হারে। ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে ৩ ভাগ রিসাইক্লিং হয়, ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে।
এদিকে বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল সায়েন্স ডিরেক্টরিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন ওজনের মোবাইল ফোনে অন্য নানা ধাতুর পাশাপাশি রয়েছে ৫৩ কেজি তামা, ১৪১ গ্রাম সোনা, ২৭০ গ্রাম রুপা, ১০ গ্রাম প্লাটিনাম ও ১৮ গ্রাম প্যালাডিয়াম। এক টন পিসিবিতে (প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড) রয়েছে ৬৭৮ গ্রাম সোনা, ১১০০ গ্রাম রুপা, ২৭৮ কেজি তামা, ৩৮ গ্রাম প্লাটিনাম, ৯৮ গ্রাম প্যালাডিয়াম। সুতরাং, এসব ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে পরিবেশ দূষণ রোধের পাশাপাশি আয় করা সম্ভব বিপুল পরিমাণ অর্থ। তবে দেশে তিন-চারটা বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে উঠলেও পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে চালাতে পারছে না। আমিনবাজারের অদূরে জে আর রিসাইক্লিং সল্যুশনস নামের একটি বেসরকারি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মঞ্জুর হাসান জানান, এক কেজি ই-বর্জ্যরে মূল্য এক ডলারেরও বেশি। কিন্তু, এগুলো সংগ্রহের কোনো চেইন সরকারি বা বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই কাঁচামালের অভাব। অপেশাদার পদ্ধতিতে কিছু বর্জ্য সংগৃহীত হয়। সেগুলো থেকে সনাতন অ্যাসিড পদ্ধতি ও বার্নিং পদ্ধতিতে মূল্যবান ধাতু পৃথক করা হয়। এতে পরিবেশ দূষণ হয়। খরচও বেশি। যারা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এসব রাসায়নিক দিয়ে স্বর্ণ আলাদা করে, তাদেরও নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
ই-বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভয়েস’র নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, রিসাইক্লিং না হওয়ায় বাংলাদেশে ই-বর্জ্য আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ অধিদফতর একটা আইন করেছে, তা কোম্পানিগুলোও জানে না, জনগণও জানে না। অন্য কোনো এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে কথাও বলছে না। বিষয়টা নিয়ে এখনই উদ্যোগ না নিলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন : ইরানে পাকিস্তানের ৯ নাগরিককে গুলি করে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা