ভোট কমছে, জনসম্পৃক্ততা নেই কর্মসূচিতে, বামদের রাজনীতি সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে- বলছেন বিশ্লেষকরা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল। ২৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে জয় পায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। পাঁচ আসনে প্রার্থী দিয়ে সবকটিতে জামানত হারায় সাম্যবাদী দল। এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। তবে নির্বাচনের আগে ও পরে এই তিন বাম দলের কর্মসূচিগুলোতে ছিল না জনসম্পৃক্ততা। ছিল হাতে গোনা কিছু মানুষের উপস্থিতি। ফলে বাম রাজনীতি অস্তিত্ব হারানোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। দলটি সবকটি আসনে জামানত হারিয়েছে। সাম্যবাদী দল ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সবকটিতে জামানত হারিয়েছে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের চার প্রার্থী সর্বমোট ১ হাজার ৫৫২ ভোট পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ভোট কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪৮-এ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটির মোট প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৮৭। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচ আসনের মধ্যে তিনটিতে পেয়েছে ১ হাজার ৫৪৪ ভোট।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রার্থী দিয়েছিল ২৬ আসনে। দুটি জোট থেকে পাওয়া। বাকি ২৪টি আসনে প্রার্থীরা লড়ে বেশির ভাগই জামানত হারিয়েছেন। জোট থেকে পাওয়া দুটির মধ্যে রাশেদ খান মেনন জয়ী হলেও ফজলে হোসেন বাদশা হেরেছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি করে আসন পায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। এরপর কোনো নির্বাচনে জয় পায়নি দলটি। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বিভিন্ন সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসনে জয়ী হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতিতে তাদের কর্মী সংকট রয়েছে। কর্মসূচিতে তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। এজন্য অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে বাম দলগুলো। যখন তাদের এই করুণ দশা তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আন্দোলন করছে। তাদের এই প্রতিবাদে কতটুকুই বা ভূমিকা রাখতে পারে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বললেও তারা নিজেরা এখনো একত্রিত হতে পারেননি। যে কারণে তাদের নিয়ে জনমনে এক ধরনের সংশয় কাজ করে। তাদের কর্মকাণ্ড তেল-গ্যাস রক্ষা আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারে- এমন কোনো কর্মসূচি নেই। গণ আন্দোলন ও গণরাজনীতিতে তাদের কোনো অবদান আছে বলে মনে হয় না।’ এসব কারণেই মূলত জনগণ বাম দলগুলোর কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে থাকেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাম রাজনীতি এখন ঢাকাকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দলগুলোর জনভিত্তি নেই। ঢাকার বাইরে জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি নেই।
তিনি বলেন, তারা বলেন জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। অথচ এসব দলের নেতারা ঢাকায় বসে বসে কথা বলেন। দলকে এগিয়ে নিতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। যদিও ’৭০-৮০-এর দশকে বাম দলগুলোর মধ্যে এসব কর্মকাণ্ড ছিল। এখন একেবারেই নেই। এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, বাম দলগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তারা কীভাবে জনগণের কাছে যাবে। কীভাবে তাদের সংগঠিত করবে। তিনি বলেন, ‘পুরনো বাম আদর্শ দিয়ে কতটুকু সফল হবে সেটা আমি জানি না এবং সম্ভাবনাও দেখছি না। যদি নতুন চিন্তা না করে এবং দলকে যুগোপযোগী না করে, তাহলে বেশি একটা সফল হবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, শুধু আমরাই নই পুরো বাম দল সংকটে। দলগুলো ভেঙে উপদলে পরিণত হওয়াই এর মূল কারণ। এ ছাড়া বর্তমান রাজনীতিও এক ধরনের সংকট তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু রাজনীতিবিদরা করেছেন। এখন ২০০ আসনে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছেন। মূল রাজনীতিবিদরা রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। এ কারণে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য, গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকটসহ মানুষের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে আমরা হাত দেব। কারণ মানুষ এগুলোর নিয়ন্ত্রণ চায়। এজন্য মানুষ আমাদের কাছে আসবে। আমরা আবার জ্বলে উঠব।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা আন্দোলন করলে অবশ্যই মানুষ আমাদের সঙ্গে আসবে। আমরা দল হিসেবে এগিয়ে যাব।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, বামপন্থি রাজনীতি সব সময় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলে। বর্তমানে বাম রাজনীতির সংকট চলছে। এ পরিস্থিতি চিরদিন থাকবে না। বামপন্থিরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবেন। তিনি বলেন, ১৪ দলের সবচেয়ে বড় দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাকিদের কোণঠাসা করে রেখেছে। ফলে আমাদের মতো দলগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বামপন্থি রাজনীতিতে সংকট চলছে। তাই বলে বাম রাজনীতির প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সর্বশেষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আমাদের সংকট ও চ্যালেঞ্জের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করছি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিভক্তি বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতির প্রধান সংকট। তবে বর্তমানে দুই ধারার বামপন্থি রাজনীতি রয়েছে। একটি হচ্ছে, ক্ষমতার কোলে বসে বামপন্থি রাজনীতি আর অন্যটি হচ্ছে জনগণের অধিকার আদায়ে রাজপথের রাজনীতি। ক্ষমতার কোলে বসে পরগাছার মতো যারা বামপন্থি রাজনীতি করছে তাদের জনগণ আর বিশ্বাস করে না। ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য বাম রাজনীতির আদর্শকে তারা বিসর্জন দিয়েছে। জনগণ আর এদের বিশ্বাস করে না। জনগণ যাদের ওপর আস্থা হারায় তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে পড়ে।
আরো পড়ুন : প্রশাসনের নীরবতায় ভয়ংকর হয়ে উঠছে রূপগঞ্জের রফিক বাহিনী