বিবিসি বাংলা : ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত বেশ কয়েকমাস যাবত বলে আসছেন যে বাংলাদেশ রিজার্ভ সংকটে পড়লে চীন পাশে দাঁড়াবে। কয়েকদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর চীনের রাষ্ট্রদূত আবারো একই কথা বলছেন।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়েছে। গত দেড় বছরের বেশি সময় যাবত রিজার্ভ ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের আশংকায় সরকারের দিক থেকে ডলার সাশ্রয়ের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় বলে আসছে যে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে।
বাংলাদেশে রিজার্ভ সংকট হলে চীন কিভাবে সহায়তা করতে পারে? চীন কেন এ ধরণের সহায়তার কথা বলছে? এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানাভাবে সহায়তার ক্ষেত্রে চীনের অংশগ্রহণ অনেক পুরনো বিষয়। অনেক দেশ চীনের কাছ থেকে ঋণের মাধ্যমে তাদের নানা উন্নয়ন প্রকল্প যেমন বাস্তবায়ন করেছে, তেমনি বাজেট সহায়তার জন্যও ঋণ নিয়েছে।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিয়ে সহায়তা করেছে চীন। সম্ভাব্য রিজার্ভ সংকটের ক্ষেত্রে চীন যে ধরণের সহায়তার কথা বলছে সেটি বাজেট সহায়তা হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বিষয়টি এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়।
চীন ‘পাশে থাকার’ কথা বললেও তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখন বাজেট সহায়তা নেবে কী-না- সেটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কিছু বলছে না।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, চীনের কাছ থেকে যে সহায়তা আসুক না কেন সেটি হবে ঋণ আকারে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, একটি হচ্ছে বাজেট সাপোর্ট দেওয়া। সেক্ষেত্রে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটি সরকার তার পছন্দমতো খরচ করতে পারে। আরেকটি হচ্ছে, আমদানির বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ঋণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া। সেটা সফট লোন হবে, হার্ড লোন হবে, নাকি মিডিয়াম লোন হবে – সেটা একটা বিষয়।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে। আমদানি অব্যাহত রাখার জন্যও ঋণ দিতে পারে – সেটি আরেকটি পদ্ধতি।
বাংলাদেশ চীনের যেসব কোম্পানির কাছ থেকে আমদানি করে সেসব কোম্পানির বিল মিটিয়ে দিতে পারে চীনা সরকার। এটিও এক ধরণের ঋণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে বহু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন থেকে যদি নানা ধরণের উপকরণ আমদানি করতে হয়, সেক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। তাহলে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।
ভারতের দেওয়া ক্রেডিট লাইনের কথা উল্লেখ করে ভট্টাচার্য বলেন, ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে যেসব জিনিস আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোর বিল পরিশোধ করছে ভারত সরকার।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ তার সময় মতো ভিন্ন আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় সেটি পরিশোধ করতে পারবে।
তবে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীনের কাছ থেকে ঋণ নেবার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা হতে পারে বলে উল্লেখ করেন ভট্টাচার্য। কারণ, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছে এবং সামনে ঋণের আরো কিস্তি আসবে।
এমন অবস্থায় চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে আইএমফ বিষয়টা মানবে কি না সেটাও একটা দেখার বিষয়, বলছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যেহেতু রিজার্ভের প্রেক্ষাপটে কথাটি বলা হয়েছে, তাহলে বাংলাদেশের ‘পাশে থাকার’ ব্যাখ্যা খুব স্বাভাবিকভাবেই হবে কোন না কোনভাবে নগদ ডলার বা ইউয়ান দেয়া। চীন তো বলেনি যে বিনিয়োগে সমস্যা হলে, তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তারা বলেছে, রিজার্ভের সমস্যা হলে পাশে থাকবে। তার মানে তোমার ক্যাশ নাই, আমরা তোমাকে ক্যাশ দেব। এটাই তো মিন (বোঝানোর) করার কথা।
জাহিদ হোসেন মনে করেন, তিনভাবে এই সহায়তা বা পাশে থাকার বিষয়টি হতে পারে।
প্রথমত: বাজেট সহায়তা কিংবা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সহায়তা হতে পারে। এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে – ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সাপোর্টের ক্ষেত্রে সেটি রিজার্ভের সাথে সরাসরি যুক্ত হবে এবং সরকার সেখানে কোন হাত দিতে পারবেনা।
এর মাধ্যমে আমদানি ব্যয় মেটানো হবে। সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে এটা কোন কোন কাজে আসবে না। অন্যদিকে বাজেট সাপোর্টের ক্ষেত্রে সরকার তার বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে। দুটো ক্ষেত্রেই ক্যাশ না নগদ দেয়া হতে পারে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে – কারেন্সি বা মুদ্রা সোয়াপ বা বিনিয়ম। যেটা চীন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জাহিদ হোসেনের মতে তৃতীয়তটি হচ্ছে – লাইন অব ক্রেডিট প্রতিষ্ঠা করা হবে। যাতে জরুরি আমদানি ব্যহত না হয়।
জ্বালানি, বিদ্যুৎ বা সারের মতো জরুরি আমদানি ব্যয়ের বিল পরিশোধ করার মতো যদি নগদ ডলার না থাকে, তাহলে সেই লাইন অব ক্রেডিট থেকে চীন সেটা পরিশোধ করে দিতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, চীন থেকে সহায়তা নেবার মতো পরিস্থিতি কি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে? বাংলাদেশে যে হারে রিজার্ভ ফুরাচ্ছে এবং আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণগুলো উঠাতে পারছেনা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যদি ডলার আসা না বাড়ে শীঘ্র, তাহলে এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। একসময় ডলার ফুরিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি বর্তমানে যে পর্যায়ে রয়েছে সেটি নিয়ে অনেকে সমালোচনা করলেও সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এনিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে চীনের অবশ্যই শক্তি আছে, অভিজ্ঞতা আছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোন সংকট নেই, বরং সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
মান্নান মনে করেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বাজেট সাপোর্ট প্রয়োজন নেই। তবে প্রজেক্ট ঋণের ক্ষেত্রে যে হারে সুদ দিতে হয়, সেটি যদি বাজেট সাপোর্টের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় তাহলে ঋণ নিতে সমস্যা নেই। বাজেট সাপোর্ট বা রিজার্ভ সাপোর্ট নেয়া সরকার যদি কোন কারণে মনে করে তাহলে এটা সরকারের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর।”
যে কোন প্রজেক্টে সহায়তা নিলেও সেটা সরকারের হাতে আসবে। বাজেট সাপোর্ট দেয়া হলে সে অর্থ এককালীন পুরো টাকা সরকারের হাতে চলে আসে। অন্যদিকে প্রজেক্ট সাপোর্ট নেয় হলে সেটি প্রজেক্ট ভিত্তিতে আসে। প্রতি বছর সেটা নিয়ে আলোচনা হয়।
চীন বাংলাদেশকে যে আশ্বাস দিয়েছে সেটি মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি হিসেবে দেখছেন মান্নান।
তিনি বলেন, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে চীন অনেক কিছুই করার ইতিহাস আছে। সুতরাং কেন আমরা অহেতুক এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব? আমি তো কোন কারণ দেখছি না। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো – চীনের সামর্থ্য আছে, আমাদেরও প্রয়োজন আছে। আমরা যেহেতু নিতে চাই, সেজন্য বাছাই প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টা আমাদের হাতেই থাকতে হবে।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা জ্বালানি কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধ করা।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, চীন যে ঋণ দিতে চাইছে সেখানে ভূ-রাজনীতির স্বার্থ জড়িত আছে।
তার কথায়, চীন যে কোন কারণে ঋণ দিতে চাইতেই পারে। আমরা কী বিবেচনায় নেব সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আরো পড়ুন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন আ.লীগের ৪৮, জাতীয় পার্টির ২