♦ সড়কে সড়কে ময়লার স্তূপ ♦ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না ♦ বর্জ্য পৃথক্করণ শুরু হয়নি এখনো
পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ পুলিশ বক্সের পাশে সড়কের ওপরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ছয়টি ময়লার কনটেইনার রয়েছে। আশপাশ এলাকার সব ময়লা এসব কনটেইনারে ফেলেন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। তবে ময়লা বেশি হওয়ায় কনটেইনার ভরাট হয়ে নিত্য রাস্তায়ও স্তূপ হয়ে যায়। এরপর টোকাইরা প্লাস্টিক বোতলসহ অন্যান্য পণ্য আলাদা করার সময় ময়লাগুলো যত্রতত্র ছিটিয়ে রাখে। ফলে নাকে-মুখে রুমাল দিয়ে চলাচল করতে হয় যাত্রী ও পথচারীদের। একই অবস্থা শ্যামবাজারের সামনের সড়কটির। বাজারের একটু পুবে রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। বেশির ভাগই কাঁচাবাজারের বর্জ্য। রাস্তার ওপরে ময়লা রাখায় যানজট ও দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ পথচারীরা। একই অবস্থা রামপুরা বাজারের সামনের প্রধান সড়কে। বাজারের উত্তর পাশে ওয়াপদা রোডের মাথায় বাজারেরসহ আশপাশ এলাকার ময়লা ফেলে ভাগাড় তৈরি করা হয়েছে। দিন-দুপুরে ময়লা ফেলে স্তূপে পরিণত করে। এসব ময়লার দুর্গন্ধে পথচারী ও আশপাশের দোকানিরা অতিষ্ঠ। সরেজমিনে ঢাকার এসব স্থানের চিত্র এমনই দেখা যায়।
শুধু এসব জায়গায় নয়, ঢাকা দুই সিটি এলাকার দুই শতাধিক উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। অথচ ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র নির্বাচনি ইশতেহারে ‘সুন্দর ঢাকা’ এবং উত্তর সিটি মেয়র ‘সুস্থ ঢাকা’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিছেন। দুই মেয়রের ইশতেহার অনেক ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। অথচ দুই মেয়রই চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা রাখতে সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণের উদ্যোগ নেয় দুই সিটির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন ও আনিসুল হক। দুই মেয়র কিছু এসটিএস নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে আনিসুল হকের ইন্তিকালের পর উত্তরের এই উদ্যোগ ভাটা পড়েছে। ঢাকা উত্তরে ৫৪টি ওয়ার্ড থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৭টিতে এসটিএস তৈরি করতে পারেনি সংস্থাটি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এখন পর্যন্ত ৬১টি ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ করেছে। দুই সিটি এলাকায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। যার ৩০ ভাগ বর্জ্য এখনো উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মোড়ক পথচারীরা রাস্তায় ফেলছেন। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য এখনো বিভিন্ন সড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০ ভাগ বর্জ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এদিকে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৭ সালে ১৫ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়ন করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এতে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। আড়াই বছর আগে খসড়া মহাপরিকল্পনার অনুমোদন দেয় দুই সিটি করপোরেশন। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়। প্রায় ২৭ মাস ওই খসড়া আটকে থাকার পর ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সেটির অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৩২ সালে রাজধানীতে দৈনিক বর্জ্য তৈরি হবে সাড়ে ৮ হাজার টন। মহাপরিকল্পনার প্রতিপাদ্য, ‘সমন্বিত ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে উন্নত শহর : শূন্য বর্জ্যরে পথে’। ‘বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃ চক্রায়ণ (রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল)’ মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে এই ত্রি-আর বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
দুই সিটিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১০ হাজার ১৭৭ জন : ঢাকার দুই সিটিতে পরিচ্ছন্নতার কাজে যুক্ত রয়েছেন ১০ হাজার ১৭৭ জন কর্মী। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ৫ হাজার ৪১২ এবং উত্তর সিটিতে ৪ হাজার ৭৬৫ জন কাজ করছেন। এসব কর্মী মূলত রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন। আর বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের পর তা এসটিএস বা অস্থায়ী বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রে নিয়ে আসেন সিটি করপোরেশনের অনুমতি পাওয়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। দিনের বেলায় রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া হলে ধুলা ওড়ে, মানুষের ভোগান্তি হয়, তাই ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এই কাজ রাত ৯টার পর শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আগে এই কাজ শুরু হতো ভোর থেকে। তবে মেয়রের নতুন নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মীরা ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত এই কাজ করছেন। তবে যত কর্মী এই কাজে যুক্ত, তারা ঠিকমতো কাজ করলে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় সকালে রাস্তায় বর্জ্য পড়ে থাকত না, ধুলাও এতটা উড়ত না।
এ প্রসঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় এখন বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ওইসব এলাকার সড়কে ঝাড়ু দেওয়া যায় না। ফলে কিছু রাস্তায় বর্জ্য পড়ে থাকে। আবার বছরজুড়েই বিভিন্ন সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করায় নগরবাসীকে ধুলার যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে।
তবে গত ১৫ বছরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, আগে রাস্তাসহ উন্মুক্ত স্থানে ময়লা বেশি ছিল। এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬১টিতে এসটিএস নির্মাণ হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে এসটিএস নির্মাণ করা। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যত্রতত্র বর্জ্য দেখতে চাই না। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সুন্দর একটি ঢাকা গড়তে চাই। নগরবাসী সহযোগিতা না করায় আমরা সেটি করতে পারছি না। আমাদের অর্থ ও লোকবল আছে কিন্তু জায়গা পাচ্ছি না। বিভিন্ন আবাসিক এলাকা হচ্ছে কিন্তু সেখানে বর্জ্য রাখার জন্য ব্যবস্থা রাখে না কেউ। সরকারি সংস্থাও এর জন্য স্থান বরাদ্দ রাখছে না। আর নতুন ওয়ার্ডগুলো সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থা গড়তে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। তার পরেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সুস্থ ঢাকা গড়তে।
আরো পড়ুন : ড. ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা