আবেগঘন মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমা

আন্তর্জাতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য ওকে নিউজ স্পেশাল জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি ধর্ম প্রচ্ছদ বিনোদন লাইফ স্টাইল শিক্ষা সফলতার গল্প হ্যালোআড্ডা

দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ, মুক্তি কামনা ও বিশ্বশান্তির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চেয়ে শেষ হলো তাবলীগ জামাতের বৃহত্তম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা। দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের প্রধান মুরুব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলবীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলবী। টঙ্গীর তুরাগ তীরের এই জমায়েতে লাখ লাখ মুসল্লি উপস্থিত হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করতে আল্লাহর দরবারে রহমত প্রার্থনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। এ সময় আখেরি মোনাজাতে ইউসুফ বিন সাদ কাঁদলেন ও অংশগ্রহণকারী সবাইকে কাঁদালেন। তাদের অশ্রুভেজা কান্না আর আমিন, আমিন শব্দে তুরাগ তীরে বিরাজ করে অন্যরকম ধর্মীয় আমেজ। মোনাজাতে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলবী আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে দ্বীনের ওপর সবাই যেন চলতে পারে সে দোয়া করেন। এ ছাড়া দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে মানুষকে হেফাজত করতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। তার সঙ্গে দুহাত তুলে আমিন আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনি তুলে কান্নায় ভেঙে পড়েন উপস্থিত মুসল্লিরা। অশ্রুসিক্ত মুসল্লিরা নিজের গুনাহ মুক্তি চেয়ে মহান আল্লার কাছে ফরিয়াদ করেন।

এর আগে ভোর থেকে শুরু হয় দিক-নির্দেশনামূলক বয়ান। শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেম ইসলামের পথে সঠিকভাবে চলার জন্য মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান দেন। মোনাজাতের আগে বয়ান শুরু করেন ইউসুফ কান্ধলবী। মোনাজাতের আগ পর্যন্ত আগত তাবলীগ ভক্তদের উজ্জীবিত করতে বিশেষ নসিহত করেন তিনি।

বয়ান শেষে সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে শুরু হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আখেরি মোনাজাত। শেষ হয় ১১টা ৪৩ মিনিটে। মোনাজাত শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই জনসমুদ্রে হঠাৎ নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। কান্নায় বুক ভাসান মুসল্লিরা। প্রয় ২৬ মিনিটের মোনাজাতে মাওলানা ইউসুফ সাদ প্রথম ১০ মিনিট পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষের দিকে ১৬ মিনিট দোয়া করেন উর্দু ভাষায়। মুঠোফোন ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্পচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ একসঙ্গে হাত তুলে দোয়ায় শরিক হন। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। গতকাল শীত কম থাকায় রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার লোকজনও আসতে থাকেন ইজতেমা ময়দানের দিকে। প্রথম পর্বের মোনাজাত সকাল ৯টায় শুরু হওয়ার কারণে সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশ এলাকার সড়ক-মহাসড়ক, অলি-গলি ও খালি জায়গায় মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।

কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পুরো ইজতেমা এলাকা। ইজতেমাস্থলে পৌঁছতে না পেরে অনেক মুসল্লি আখেরি মোনাজাতের জন্য খবরের কাগজ, পাটি, বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং অলি-গলিসহ বিভিন্নস্থানে অবস্থান নেন। নানা বয়সী বিভিন্ন পেশার মানুষের পাশাপাশি নারীদেরও মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। এমনকি বাসাবাড়ি ও কারখানার ছাদ, নৌকা, বাসের ছাদসহ যে যেখানে পেরেছেন সেখানেই বসে দুই হাত তুলে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। আয়োজকরা জানায়, দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২০ লাখ মুসল্লি অংশ নেন। পাশাপাশি বিশ্বের ৬৫ দেশের প্রায় ১০ হাজার মেহমানও ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেন। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো ২০২৪ সালের বিশ্ব ইজতেমা।

ইজতেমা নিয়ে জটিলতার কারণে কয়েক বছর হলো ইজতেমায় আসেননি তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভী। তবে গত দুই বছর ধরে আসছেন তার তিন ছেলে। বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউছুফ বিন সাদ কান্ধলভী গত শুক্রবার জুমার নামাজের ইমামতি করেন এবং গতকাল আখেরি মোনাজাতও তিনিই পরিচালনা করেছেন। মেজো ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ সাঈদ বিন সাদ কান্ধলভী ও তৃতীয় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস বিন সাদ কান্ধলভী এবং জামাতা মাওলানা মোহাম্মদ হাসান দ্বিতীয় পর্বের ৩ দিনই বেশির ভাগ সময় বয়ান করেছেন। মোনাজাতের আগে বিশ্বব্যাপী তাবলীগ জামাতের সাথীদের উদ্দেশ্যে হেদায়েতি বয়ান পেশ করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। ২৬ মিনিট স্থায়ী আখেরি মোনাজাতের প্রথমেই তিনি মহান আল্লাহ তালার প্রশংসা করেন। অতঃপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরূদসহ কোরআনের অসংখ্য দোয়ার আয়াত ও হাদিসের অসংখ্য মাসনুন ও ফজিলতপূর্ণ দোয়া পাঠ করেন। মোনাজাতে তিনি বলেন, হে আল্লাহ আমাদের জামাতের সঙ্গে তাকবিরে উলার সঙ্গে নামাজ পড়ার তওফিক দিন। আমাদের সব আমল কবুল করুন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে দাওয়াতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতার বিষয়ে অবগত থাকার তওফিক দান করুন।

দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে আপনি দ্বীনের কাজ চালু করে দিন। হে আল্লাহ! দ্বীনের দাওয়াতে দেশ-বিদেশে যত জামাত কাজ করছে তাদের হিম্মত বাড়িয়ে দিন। কাজে আগে বাড়ার তওফিক দান করুন। সব বাধা ও সমস্যা দূর করে দিন। সবার ভেতর দ্বীনের ফিকির দান করুন। ঐক্যবদ্ধ থাকার তওফিক দিন। আমাদের বিভেদকে মিটিয়ে দিন। আমাদের মনে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে হেফাজতে রাখুন।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা: এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নজীরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সাড়ে ৬ হাজারের অধিক পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি দায়িত্বরত ছিল সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল, নৌ-পথে স্পিড বোটে সতর্ক টহল ও নজরদারি। আকাশ ও নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসল্লিসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে স্থাপিত র‌্যাবের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছিল। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন।

ইজতেমা ঘিরে মৌসুমী ব্যবসা: টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে বাহারি সব পণ্যের ব্যবসা খুলে বসেছিলেন স্থানীয় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি হকার ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ছিল জমজমাট ব্যবসা। টঙ্গীর তুরাগ পাড় ছাড়াও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা রাস্তার দুই পাশে তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে মুসল্লিরা পায়ে হেঁটেই ফিরছেন অনেকেই। এসব মুসল্লিদের জন্য রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিক্রি হয় আতর, টুপি-জায়নামাজ, তসবিহ, চাদর, কম্বল ও জ্যাকেটসহ নিত্যপণ্যের সকল দ্রব্যসামগ্রী।

মোনাজাত শেষে ভোগান্তি: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মোনাজাত করতে আসা মানুষগুলো শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশেপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে বাধ্য হয়েই ফের পায়ে হেঁটে রওনা দেন তারা। আর পায়ে হাঁটা মানুষদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন গতকাল বিকাল পর্যন্ত থেমে থাকে ইজতেমা মাঠের আশেপাশের এলাকায়।

দ্বিগুণ ভাড়া আদায়: আখেরি মোনাজাত শেষে দুর-দূরান্তের মুসল্লিরা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে একযোগে যাত্রা করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রীবাহী কোনো গাড়ি না থাকায় বাধ্য হয়েই অনেককে দ্বিগুণ/তিনগুণ ভাড়া দিয়ে পিকআপ ভ্যান ও রিকশা ভ্যানে করে যেতে দেখা গেছে।

পত্রিকার পাতা ও পরিত্যক্ত জুতা: আখেরি মোনাজাত শেষে হুড়োহুড়ি করে ইজতেমা ময়দান থেকে বের হতে গিয়ে অগণিত জুতা-স্যান্ডেল ফেলেই খালি পায়ে মাঠ ত্যাগ করেন মোনাজাতে অংশগ্রহণ করা অনেক মুসল্লিরা। এ ছাড়াও মোনাজাত শেষে ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের সড়কগুলোতে বিপুল পরিমাণ পত্রিকার পাতা, জুতা ও স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

ভিক্ষুকের আনাগোনা: বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শুরু হওয়ার আগেই ময়দানের চারপাশের ফুটপাথগুলোতে ভিক্ষুকের আনাগোনা বেড়ে যায়। নোংরা ও ময়লা কাপড় পরে সাহায্যের জন্য মুসল্লিদের পথ আগলে ধরায় অনেক মুসল্লিরা বিব্রতবোধ করেন। এদিকে বিদেশি মুসল্লিদের নিবাস এলাকায় ভিক্ষুকদের ভিড়তে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষুকদের বারবার বিদেশিদের পথ আগলে ধরে ভিক্ষা চাইতে দেখা গেছে।

দ্বিতীয় পর্বের আয়োজক কমিটির সন্তোষ প্রকাশ: টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বিরা জানান, আলহামদুলিল্লাহ। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এবারের দু’পর্বের ৫৭তম ইজতেমার সমাপ্তি হয়েছে। ইজেতেমার সার্বিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মিডিয়া সমম্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিদের আসতে এবং ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের প্রতি ইজতেমা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গাজীপুর-২ আসনের এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, সরকারের সকল সেবাদান প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সার্বিক সহযোগিতায় আল্লাহর রহমতে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এবারের বিশ্ব ইজতেমা সম্পন্ন করতে পেরেছি। এবারের ইজতেমা আগের বছরের চেয়েও অনেক ভালোভাবে সমাপ্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলে নিরলস পরিশ্রম করে বিশ্ব ইজতেমাকে সাফল্যমণ্ডিত করায় দেশবাসীসহ সবাইকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

আরো পড়ুন : হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বিপন্ন ইসরায়েলি বাহিনী

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *