আমি আর বাঁচবো না। আমাকে হাসপাতালে নিও না। হুজুর আমাকে কালেমা পড়ান। আমি পানি খাবো। পানি দাও। ছেলের শেষ মুহূর্তের কথাগুলোর স্মৃতিচারণ করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন র্যাবের গুলিতে নিহত মোহাম্মদপুরের বসিলার বাসিন্দা মিরাজুল ইসলাম অর্ণবের মা সাহিদা বেগম। মানবজমিন’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আর্তনাদ করে অর্ণবের মা বলছিলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। ওদের একটুও মায়া হলো না? প্রথমে পায়ে গুলি করে। পরে বুকের বাম পাশে গুলি করে। যেটা বুকের একপাশ ভেদ করে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের বাসা মোহাম্মদপুরের বসিলায় র্যাব ২ কার্যালয় সংলগ্ন। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকি তার সামনে মূল সড়কে গত ১৯শে জুলাই সকাল থেকে দফায় দফায় ছাত্রদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় অর্ণব বাসাতেই ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় কিছুক্ষণ ফোনে ডাউনলোড করা গেমস খেলার পর নিচে নামে। এরপর আবার বাসায় আসলে দুপুরে গোসল করতে বলি। অনেক সময় নিয়ে গোসল শেষ করে। এরপর ৩ তলায় থাকা এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাসায় এসে ভাত খায়। ওই শিক্ষার্থী মেসে থাকায় মাঝে মধ্যেই অর্ণব বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে ডেকে খাওয়াতো। খাওয়া শেষ করলে আমি মসজিদে যাওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেই। ও বাইরে চলে যায়।
এ সময় ওর বোন জামাইয়ের দেয়া আইফোনটি সঙ্গে ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ পরপর গুলির শব্দ শুনে রাস্তায় ছুটে আসি। চোখের সামনে দিয়ে হতাহতদের নিয়ে যাচ্ছিল। দুপুরে মূল সড়কে দাঁড়িয়ে সংঘর্ষের ঘটনা দেখছিল অর্ণব। এ সময় হঠাৎ র্যাব গুলি করে। অর্ণবের সঙ্গে থাকা ছেলেটি দৌঁড় দেয় এবং অর্ণবের পায়ে প্রথমে গুলি লাগে। এরপর বুকে গুলি লাগলে মাটিতে ঢলে পড়ে। সঙ্গে থাকা ছেলেটি অনেক কষ্টে টেনেহিঁচড়ে অর্ণবকে স্থানীয় একটি মসজিদে নিয়ে যায়। এই মসজিদেই দুপুরে নামাজ পড়েছিল অর্ণব। এ সময় মসজিদের হুজুর অর্ণবকে কালেমা পড়ান। হুজুরের কাছে পানি খেতে চায়। তাকে পানি খাওয়ানো হয়। পানি খাওয়ার পর একটি ভ্যানে তোলা হয়। অর্ণব তখন বারবার বলছিল আমি বাঁচবো না। আমাকে হাসপাতালে নিও না। এদিকে অর্ণবের বুক পিঠ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছিল। ভ্যানে করে প্রথমে দুই হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি করতে না পেরে পরবর্তীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে অর্ণবকে আমরা পাগলের মতো খুঁজছিলাম। সঙ্গে থাকা ছেলেটি আমাদের কারও ফোন নম্বর জানে না। বিকালে হঠাৎ অর্ণবের ফোনে ফোন দিলে সঙ্গে থাকা ছেলেটি জানায় অর্ণব গুলিতে আহত। এ সময় আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। ততক্ষণে সব শেষ। অর্ণব মারা যায়। সময়টা আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট।
তিনি বলেন, বুক থেকে রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছিল ওর বুকের গুলি পিঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গর্ত হয়ে গেছে। এতটা কষ্ট দিয়েও মানুষ মানুষকে মারতে পারে। আমার ছেলে তো কোনো আন্দোলনে ছিল না। ওর কি দোষ ছিল। ওকে বড়জোড় পায়ে একটি গুলি করতে পারতো। কিন্তু বুক কেন ঝাঁঝরা করে দিলো। আমি এর বিচার চাই। আমার সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিল ২৩ বছরের এই ছেলেটি। এখন আমাদের কী হবে? কে দেখবে আমাদের সংসার। আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা নাই। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো সহমর্মিতা কিংবা আর্থিক সহযোগিতা পাইনি। এ ঘটনায় মামলা করেছেন কিনা জানতে চাইলে অর্ণবের মা সাহিদা বেগম বলেন, কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? তাছাড়া আমার তো মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই। এ সময় তিনি ছেলে হত্যার সঠিক তদন্তসহ বিচারের পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য কামনা করেন। অর্ণবের মা বলেন, এইচএসসি পাস করার পর অর্থনৈতিক কারণে আর ভর্তি হতে পারেনি। সংসারের হাল ধরেছিল। ওর আয়েই সংসার চলতো। ছেলেকে বিয়ে করাবেন তাই সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে পাত্রী দেখছিলেন। অর্ণবের বাবা ইতালি প্রবাসী হলেও বর্তমানে তিনি বেকার এবং অসুস্থ জীবনযাপন করছেন। মা সাহিদা বেগমও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে অর্ণব ছোট। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অর্ণবের সঙ্গে সঙ্গে গোটা একটি পরিবারের সকল স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মা সাহিদা।
সুত্র- মানবজমিন
আরো পড়ুন : জামিন পেল ৪২ এইচএসসি পরীক্ষার্থী