“ওরা আমার পোলার মাথায় গুলি করেছে। গুলি ডান পাশ দিয়ে ঢুকে, বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। গোসলের সময় পিঠেও ছিদ্র দেখেছি। পিঠে বড় একটা গর্ত হয়ে গেছে। সেদিন আমার ফারুক ধাওয়া খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিল। দৌড়ে এসে পাষণ্ডটা (কাউন্সিলর) আমার ছেলের বুকের উপর পাড়া দিয়ে ধরে মাথায় গুলি করেছে। একটা না দুইটা গুলি করেছে। গুলি করার পরেও কয়েকটা লাথি মেরেছে। আমার বাবা তখনই মরে গেছে। পরে লোকজন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ওখানে নেয়ার পরে ডাক্তার বলেছে, মারা গেছে। ওরা এমনভাবে মেরেছে, পোলাডার চিকিৎসাও করাতে পারি নাই। মাত্র ২ মিনিটে মেরে ফেলেছে। আমার আব্বাটা বাঁচার সুযোগ পায়নি।” বিলাপ করছিলেন আর এই কথাগুলো বলছিলেন গত ৪ঠা আগস্ট মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত ১৬ বছর বয়সী ওমর ফারুকের বাবা মিলন ফরাজি। মিলন ফরাজি বলেন, সিকদার হাসপাতালে লাশ আনতে গিয়ে দেখি ওখানে মারামারি চলছে। ছাত্রলীগের ছেলেরা হাসপাতালেও হামলা করছে। গুলি লাগার পরে যাদের হাসপাতালে আনা হইছিল, তাদের চিকিৎসা করাতে দিবে না। হাসপাতালের লোকদেরও মারধর করেছে। পরে লোকজন এক হয়ে তাদের ধাওয়া দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। রাত ৮টায় পোলার লাশ এনে গোসল করাই। পরে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করতে নিলে তারা ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তারা বলছে, সরেন দূর হয়ে যান। এখানে কোনো কবর দেয়া যাবে না। আগে পুলিশের অনুমতি নিয়ে আসেন তারপরে গোরস্তানে ঢুকতে দিবো। রাত ১০টার পরে আমি মোহাম্মদপুর থানায় যাই। পুলিশের কাছে বললাম স্যার, আমার পোলাডারে কবর দিতে দেয় না। আপনাদের কাছ থেকে কাগজ নিতে বলছে। তখন পুলিশ বলে, আপনাকে থানায় আসতে সাহস দিলো কে? থানা থেকে বের হয়ে যান। পুলিশের কাগজ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দিবা নাকি? এই বুদ্ধি নিয়ে আসছো? ওসির কাছে গেলে সেও ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। রাত ১১টায় বাসায় এসে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে চান্দা তুলে রাত ১টার দিকে পিকআপ ভাড়া করে ছেলের লাশ ভোলার চরফ্যাশনে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করি। আমার বাপেরে দূরদেশে রেখে আসতে হইলো। ইচ্ছা করলেই পোলাডার কবরও দেখতে পারবো না।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত ওমর ফারুক মোহাম্মদপুর নুরজাহান রোডের একটি মুদি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। বয়স ১৬ বছর। বাসা কাদিরাবাদ হাউজিংয়ের বোর্ডঘাট এলাকায়। ৪ঠা আগস্ট ২টা ৪০ মিনিটে দুপুরের খাবার খেতে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ফারুক। তবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সংঘর্ষ দেখে আটকে যান। পরে ঘটনাটি মুঠোফোনে তার মাকে জানান। মা ইয়ানুন বেগম সাবধানে বাসায় আসতে বলে ফোন রেখে দেন। প্রায় এক ঘণ্টা মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে আটকে থেকে গলির মধ্যদিয়ে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে যান ওমর ফারুক। সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। বিকালে সাড়ে ৪টার দিকে কালভার্ট ফুটওভার ব্রিজের নিচে স্থানীয় কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ দলবল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। ওই সময় ধাওয়া খেয়ে ওভার ব্রিজের নিচে পড়ে যান ওমর ফারুক। সেখানেই ফারুক মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। ওইদিন ঘটনাস্থলে থাকা রবিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, ওমর ফারুক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময়ে সামনের সারিতে ছিল। আসিফ কাউন্সিলরের লোকজন যখন ছাত্রদের ধাওয়া দেয়। তখন ওমর ফারুক রাস্তায় পড়ে যায়। পরে দৌড়ে এসে ওর মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত বলেন।
জানা গেছে, ওই ঘটনায় মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম কোর্টে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলা নং ৫২১/২৪। মামলায় কাউন্সিলর আসিফ আহমেদসহ আরও ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অঅরো পড়ুন : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প মাতারবাড়ীতে ১৭৭০ কোটির দুর্নীতি