হু হু করে ঘরে পানি ঢুকায় কয়েকটা কাপড় ছাড়া কিছুই আনতে পারেননি ইউসুফ

অর্থনীতি ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ জাতীয় প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

ফেনী প্রতিনিধি: আবু ইউসুফের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। গতকাল বুধবার রাতে প্রবল স্রোতে পানি এসে আছড়ে পড়ে তাঁর বসতভিটায়। এরপর পানির উচ্চতা শুধুই বেড়েছে। ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় আবু ইউসুফ বলেন, ‘হু হু করে ঘরে ঢুকেছে বন্যার পানি। দ্রুতই বেড়েছে সেই পানি। কয়েকটা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে আসি।’

আবু ইউসুফের বাড়ি ফেনীর ভাঙা তাকিয়া বাজার এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে তাঁর বসবাস। আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি স্ত্রী ও ছেলেদের খোঁজে মহাসড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে একটি পানির বোতল ও কিছু কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।

আবু ইউসুফ জানান, তাঁর চার ছেলে। ছেলেরা স্ত্রীকে পানির ভেতর থেকে কোনোরকমে উদ্ধার করে সড়কে এসেছিলেন। এরপর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ছেলেদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে ধারণা করছেন, অদূরের একটি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। তিনিও সেখানে যেতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন।

বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে, জানতে চাইলে আবু ইউসুফ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন, তাঁর কৃষিজমি ডুবে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, তিনটি গরু ও ৫০-৬০টি মুরগি, ধানের গোলা।

ফেনী জেলার ছয় উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়ন এখন বন্যার পানিতে ডুবে আছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ; পানিতে ডুবে আছে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছে আবু ইউসুফের মতো লাখো মানুষ। যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের ঠিকানা হয়েছে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, স্থানীয় মসজিদ ও মন্দিরে। বিভিন্ন স্কুলের ছোট ছোট কামড়ায় জবুথবু হয়ে রয়েছেন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী ও পুরুষ, শিশু ও তরুণ।

বন্যা–পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।

এর আগে প্রবল বৃষ্টিতে ২ আগস্ট পরশুরামের মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ১২টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর গত চার দিনের ভারী বৃষ্টিতে মুহুরী নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে তিন উপজেলার ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্যার পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় গতকাল রাত থেকেই বিদ্যুৎ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ফেনী সদরের ছনুয়া ইউনিয়নের ভাঙা তাকিয়া, কালিদহ ইউনিয়নের মাইজবাড়িয়াসহ সংলগ্ন এলাকায় আজ উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া একটি দল।

বেলা সাড়ে তিনটায় ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত তাঁরা ৫৫ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়েছেন।

কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে : জগলুল ইসলাম মানুষের জমিতে খেটে যা পান, তা-ই দিয়ে সংসার চলে। বন্যায় তাঁর ঘুণে ধরা বেড়ার ঘরটি ভেঙে পড়েছে। শৌচাগার, রান্নাঘরও তলিয়ে গেছে। পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছেন মিরসরাইয়ের এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

মাথার ওপর চাল ও আলুর বস্তা নিয়ে বুকপানিতে হেঁটে আসছিলেন তিনি। তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটার ঘরে। জগলুলের বাড়ি ফেনী সদরের কালীদহ ইউনিয়নের হাফেজিয়া মাদ্রাসা এলাকায়। বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বড় বন্যা হবে, তা কখনো ভাবিনি। পূ্র্বপ্রস্তুতি ছিল না। আমার একটি গরু পানিতে ডুবে মারা গেছে।’

জগলুল ইসলামের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে ফেনীতে আরেকবার বন্যা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বাড়ি ডোবেনি। এবারের মতো পানি তিনি আর দেখেননি।

সালমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। তাঁর বাড়িঘর ডুবে গেছে। ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সত্তরোর্ধ্ব সালমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে তাঁকে বাড়ি থেকে উদ্ধার করে সড়কে রেখে গেছেন। ছেলে বোট নিয়ে বাড়িতে গেছেন। ফিরলে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন।

কোথাও বুকসমান, কোথাও গলাপানি : ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা কার্যত পানির নিচে। আজ সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও বুকপানি, কোথাও গলা অবধি। দক্ষিণ মাইজবাড়িয়া, হাফেজিয়া মাদ্রাসা, ভাঙা তাকিয়াসহ একাধিক গ্রামে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।

বেলা দুইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, ফেনী সদরের ৬ নম্বর কালীদহ, ৭ নম্বর বালিগাঁও, ৯ নম্বর লেমুয়া, ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম এখন পানির নিচে। এসব গ্রামের বেশির ভাগ একতলা ঘর তলিয়ে গেছে। ফসলি জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট; সবকিছুই ডুবে আছে। কেউ কেউ কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বুকপানিতে সাঁতরে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

মাইজবাড়িয়া এলাকার ভেতরে একটা গাছ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুফিয়া বেগম নামেরএক নারী। পানির প্রবল স্রোত তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিস তাঁকে উদ্ধার করে। পরে তিনি জানান, পরিবারের অন্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিলেও তিনি আটকে গিয়েছিলেন।

একই এলাকায় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিকে খুঁজতে এসেছিলেন হাজেরা আক্তার। তিনি জানান, কালিদহ ইউনিয়নে তাঁর বাড়ি। ছেলে মাইজবাড়িয়া এলাকায় ভাড়া থাকেন। কিন্তু সকাল থেকেই মুঠোফোনে কল ঢুকছে না। ছেলেন ভাড়া বাসাও তলিয়ে গেছে।

অন্যদিকে ভাঙা তাকিয়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানপাট পানির নিচে। দোকানগুলোতে জিনিসপত্র ভাসছিল।
প্রথম আলোর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

আরো পড়ুন : ফেনীর বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে ১৭টি স্পিডবোট ভাড়া নিলেন শিক্ষার্থীরা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *