রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসীতে সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার কারখানায় দ্বিতীয় বারের মতো আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
রবিবার (২৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কারখানার ৬তলা বিশিষ্ট ভবনে লাগা আগুন সোমবার (২৬ আগস্ট) বেলা ৩টায়ও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট টানা কাজ চালিয়ে যাছেন।
কারখানায় অগ্নিসংযোগের পর একদল দুর্বৃত্ত কারখানায় থাকা মালামাল লুটপাট চালিয়েছেন। লুটপাট করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। ইতোমধ্যে স্বজনরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে নিখোঁজদের নাম ঠিকানা দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানা রয়েছে। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ শত শত লোকজন ও লুটপাটকারীরা লাঠিসোটা নিয়ে গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানায় প্রবেশ করে ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট শুরু করেন। এক পর্যায়ে ওই দু’টি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে, রূপগঞ্জের নবকিশোলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামি গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার এবং নারায়ণগঞ্জ আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করার পর আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ খবরের পরই গতকাল রবিবার সন্ধ্যার দিকে কয়েক শতাধিক লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে রূপসী গাজী টায়ার কারখানার সামনে ও ভেতরে ঢুকে পরে। এরপর আবারও ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করেন। স্থানীয় বেশ কিছু বিএনপি নেতাকর্মীরা এসে ভাঙচুর ও লুটপাটে বাধা দিলে তা না মেনে ভাঙচুর ও লুটপাট চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ৬তলা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন কয়েক শতাধিক লোকজন। ওই ভবনে ক্যামিকেল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল। ভবনের ভেতরে লুটপাট নিয়ে দু’টি পক্ষের মাঝে হাতাহাতি ও মারপিটের ঘটনা ঘটে।
এ সময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পুরো ভবনে আগুন লেগে যায়। এ সময় আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে আগুনের লেলিহান শিখা ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচুতে উঠে পড়ে। ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন।
পরে খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সোমবার বেলা ৩টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
এদিকে, ভবনে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের খোঁজে গাজী টায়ার কারখানায় ভীড় করছেন স্বজনরা। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কাছে প্রায় দেড় শতাধিক নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা। বেশির ভাগ নিখোঁজদের বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, মুড়াপাড়াসহ আশ-পাশের এলাকার।
বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খান, শাহিনসহ ৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হয়নি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে তারা ভবনে আটকা পড়েছে। আমাদের বাঁচান। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।
কোনাপাড়া এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, তার মেয়ের জামাই হযরত আলী গাজী টায়ার কারখানায় মালামাল নিতে আসছে। বাড়ি থেকে বলে আসছে। এখন আর তার খোঁজ পাচ্ছি না। শুনছি আগুন লাগছে যেই ভবনে সেখানে আটকা পড়েছে।
মাসাবো এলাকার আসাদ মিয়া বলেন, তার ছোট ভাই বাবু মিয়া কসাইয়ের কাজ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে গাজীর কারখানা থেকে মাল নিতে আসে। রাত ১০টা পর্যন্ত কথা হইছে এরপর থেকে আর কথা হয়নি।
বরপা এলাকার সুরাইয়া বেগম বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার নাতি নিরব ও তার বন্ধু মিল্লাত মিলে টায়ার কারখানায় প্রবেশ করে। পরে যেই ভবনে আগুন লেগেছে ওই ভবনে আটকা পড়ে। এখন আর খোঁজ পাচ্ছি না।
ভয়াবহ এই আগুনে কারখানার আশ-পাশের মার্কেট, হাটবাজার, শিল্প কলকারখানা এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিএনপি নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষক) রেজাউল করিম বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগুন নেভানোর পর নিখোঁজদের ব্যাপারে বলা যাবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ অপরাধ করলে সাংগঠনিকভাবে দল থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গাজী সাহেব অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুটি রোজগারের জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংস করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কোথায় যাবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কেউ কোনো প্রকার অরাজকতা, লুটপাট, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবে। প্রচলিত আইনে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরো পড়ুন : দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আমাদের কখন ছাড়বে: প্রধান উপদেষ্টা