জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মতিঝিল ও শাহজাহানপুরকেন্দ্রিক বিরোধের নানা তথ্য সামনে আসছে। হত্যা মিশনের ছয়/সাত দিন আগে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ হুমকি দিয়ে টিপুকে ফোন করেছিলেন। ক্রীড়া পরিষদের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে ওই হুমকি দেওয়া হয়।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা গতকাল সমকালকে মোল্লা মাসুদের ওই ফোনকলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। টিপুর হত্যার সঙ্গে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদসহ আরও তিনজনের সংশ্নিষ্টতার বিষয়ে নিবিড় তদন্ত করা হচ্ছে। অপর তিন সন্ত্রাসী জিসান, ইকতিয়ার ও মানিক। তবে তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মতিঝিল ও শাহজাহানপুরে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। সংগঠনে কোনো পদ না থাকলেও টিপু ও তার লোকজন এসব নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। এতে স্থানীয় নেতাদের কারও কারও সঙ্গে টিপুর এক ধরনের শীতল সম্পর্ক ছিল। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য দেশে-বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীদের কেউ ব্যবহার করেছেন কিনা, সেটা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে, মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিনকে হুমকি দিয়ে ফোন করা হয়েছে। ইন্টারনেট মাস্কিং কলে ফোনটি তার কাছে গেছে। গত রোববার তাকে ফোন করে টিপুর ‘পরিণতির’ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ফোনের ওপাশ থেকে কয়েকবার বলা হয়, ‘হ্যালো, টিপুকে চেনেন। মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। আপনি তো ভালোই আছেন। দুই স্কুল তো সকাল-বিকেল ভালোই চালাচ্ছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি আবদুল আহাদ বলেন, ‘রিয়াজের ঘটনাটি আমরা জানি। প্রযুক্তিগত তদন্তে দেখেছি, যখন তাকে হুমকি দেওয়া হয়, তখন মৎস্য ভবন এলাকায় তার অবস্থান ছিল। আর রিয়াজের বাসা মতিঝিল এলাকায় নয়। তাই তাকে জিডি করতে চাইলে রমনা থানায় করতে বলেছি।’
আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ সমকালকে বলেন, হুমকির ঘটনা উল্লেখ করে থানায় জিডি করেছি। পুলিশ দেখবে- পছনে কারা আছে।
২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক টিপুকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর টিপুর স্ত্রী সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি পুলিশকে জানান, হত্যার আগে কে বা কারা তার স্বামীকে হুমকি দিয়েছিল। তবে হুমকির বিষয়টি টিপু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। গত রোববার গোড়ানের বাসিন্দা মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের দাবি, মাসুমই একমাত্র শুটার। গতকাল রাতে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
টিপু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী এবং অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহকারীদের শনাক্ত করতে নানামুখী তদন্ত অব্যাহত আছে। ১৪/১৫ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর ও মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্র জানায়, মতিঝিল ও শাহজাহানপুরে নানা অবৈধ কারবার ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ওই এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত জিসান, মোল্লা মাসুদ, ইকতিয়ার ও মানিক দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পলাতক। তবে ফেরারি জীবন কাটালেও এলাকার অবৈধ কারবারের বখরার একটি অংশ সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে যায়। অনেক সন্ত্রাসী বিদেশে বসেই তাদের পছন্দের লোকজন যাতে বড় বড় দরপত্র পেতে পারেন, সেই তদবির করেন। তাতে কাজ না হলে তারা হুমকিও দিয়ে থাকেন। সর্বশেষ ক্রীড়া পরিষদের কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষিপ্ত হয় মোল্লা মাসুদের লোকজন। ক্রীড়া পরিষদের কাজে টিপুর নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাই হত্যাকাণ্ডের ছয়/সাত দিন আগে টিপুকে ফোন করে ‘সতর্ক সংকেত’ দেন মোল্লা মাসুদ।
দীর্ঘ দন ধরে ভারত থেকে ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন মোল্লা মাসুদ। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা রয়েছে। তিনি ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশে থাকার সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ দেখা গেলেও বিদেশে পালানোর পর তারা ‘একত্র’ হয়ে যান। সময় সময় জিসান দুবাই থাকলেও মাঝেমধ্যে ভারতে এসে পলাতক অনেকের সঙ্গে বৈঠক করেন। অন্তত দুই দশক আগে মালিবাগে সানরাইজ হোটেলে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী অবস্থান করছে- এ তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশের ‘চিতা-কোবরা’ টিম। এর র হোটেলের একটি কক্ষের দরজা নক করার পরই ভেতর থেকে গুলি করা হয়। এতে মারা যান পুলিশ পরিদর্শক মো. আলমগীরসহ দুই কর্মকর্তা। ওই মামলায় আসামি সন্ত্রাসী ইকতিয়ার ও জিসান।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোছা বাবুও মতিঝিলে খুন হন। ওই মামলার চার্জশিটভুক্ত পাঁচ আসামির সঙ্গে টিপুর বিরোধ ছিল। তারা মনে করেন, রিজভীর বাবা মো. কালাম হাসান ওরফে কালাকে ম্যানেজ করে ওই মামলায় তাদের ফাঁসিয়েছেন টিপু। রিজভী হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক তার সহযোগী সুমন ওরফে মুসা ও নাসির উদ্দিনকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ এই হত্যা মিশনে ব্যবহার করেছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে মানিকের হয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা আরেক সন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চলছে। মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকায় ঠিকাদারি, ফুটপাত, গরুর হাট, কাঁচাবাজার, ক্লাবপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের মধ্যে এক ধরনের বলয় আছে। একজনকে পেছনে ফেলে আরেকজন এসব নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিযোগিতায় থাকেন।
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি বশিরুল আলম খান বাবুল বলেন, টিপু রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। দলেও পদ ছিল না। তিনি তার ব্যবসা নিয়ে থাকতেন। ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডার তার হাতে ছিল। তার নিয়ন্ত্রণে ছিল আইডিয়াল স্কুলও। এজিবি কলোনিতে একটি মার্কেট নিয়ে অনেকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল তার।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, কে শুটার মাসুমের মোটরসাইকেলে ছিলেন, সে নামটি তারা জানতে পেরেছেন। তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল এখনও জব্দ হয়নি। মাসুম জিজ্ঞাসাবাদে জানান, এর আগে ছাত্রদল নেতা হাবিবকেও গুলি করেছিলেন তিনি।