নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম আদালতে ইসকন নেতা ও সনাতন সম্মিলিত জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুরের পর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী নিহতের ঘটনায় দিনভর উত্তপ্ত ছিল বন্দরনগরী। গতকাল সোমবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করে ঢাকা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে তাঁকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করার পর থেকে উত্তেজনার শুরু। তাঁর সমর্থক একদল বিক্ষোভকারী প্রায় তিন ঘণ্টা তাঁর প্রিজনভ্যান আটকে রাখে। পুলিশ সরাতে গেলে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ওই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লোকজনদের মধ্যে চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত সনাতন ধর্মাবলম্বী আইনজীবীরাও ছিলেন।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানো ও রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে দিনভর পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও থমথমে ছিল। বিক্ষোভের মধ্যে অনেকের হাতে দা-বটিসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র থাকতে দেখা গেছে।
যেভাবে বিক্ষোভ ও সহিংসতার শুরু হয় : গতকাল সোমবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে তাঁকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজ মঙ্গলবার তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রতি এক বিএনপি নেতার (পরে বহিষ্কৃত) দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে তোলা হয়। এ সময় চিন্ময়ের আইনজীবীরা তাঁর জামিন আবেদন করেন। পরে আদালত চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের পর গতকাল সোমবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান ও চেরাগি পাহাড় মোড়ে বিক্ষোভ হয়।
পুলিশের সূত্র জানায়, সোমবার রাতেই চিন্ময়কে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আজ বেলা ১১টার দিকে চিন্ময়কে আদালতে তোলা হয়। এর আগে আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন তাঁর সমর্থকেরা। এ সময় আদালত জুড়ে পুলিশ, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ছিল।
চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুর : মঙ্গলবার সকালে আদালতে তোলার পর চট্টগ্রামের ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালত চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে সনাতনী জাগরণ জোটের এই মুখপাত্রকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় প্রিজনভ্যানে ওঠানো হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীদের বাধার কারণে প্রিজনভ্যানটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হতে পারেনি। প্রায় তিন ঘণ্টা প্রিজনভ্যান আটকে রাখার পর বিকেল ৩টা নাগাদ পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাঁধে।
বিক্ষোভকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
একপর্যায়ে আসামি চিন্ময়কে প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশের একটি পিকআপে তুলে প্রচলিত সড়ক দিয়ে না গিয়ে আদালতের পেছনে বিকল্প পথ দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে যে গাড়িতে করে নেওয়া হয়, সেটির সামনে-পেছনে কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল। তাঁকে কারাগারে নেওয়ার সময়ও বিক্ষোভকারীরা বিক্ষিপ্তভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে।
বিক্ষোভকারীরা আদালতে যাওয়া-আসা সড়ক লালদীঘি এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান ঘটনাস্থলে থাকতে দেখা যায়।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে বিক্ষোভকারীরা একটি মসজিদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। আহতদের সংখ্যা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
আইনজীবী নিহতের পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত: মঙ্গলবার বিকেলে সংঘর্ষে ১৯ জন হতাহতের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম নামে রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামে লোহাগাড়া উপজেলার জালাল উদ্দিনের ছেলে সাইফুল ইসলাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে জানান তাঁর সহকর্মী আদালতের আরেক সহকারী পিপি অ্যাডভোকেট এনামুল হক।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম আদালতে সংঘর্ষের ঘটনায় বিকেলে হতাহত ৭ জনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। বাকিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যে পড়ে একজন নিহত হয়েছেন। নিহতের শরীরের লক্ষণ দেখে মনে হয়েছে তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে কে বা কারা তাঁর ওপর হামলা চালিয়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটা তদন্ত চলছে।’ নিহতের ঘটনায় একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
অতিরিক্ত উপকমিশনার বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের ১২ জন সদস্য ও ৬ জন সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন বলে আমরা সর্বশেষ তথ্য পেয়েছি।’
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে চট্টগ্রাম আদালতের প্রবেশমুখের সামনে লালদীঘি সড়কে রঙ্গম টাওয়ারের সামনে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে কে বা কারা এই হামলায় জড়িত ছিল তা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে সংঘর্ষ চলাকালে বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে দা-বটি দিয়ে সেখানে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম রাজ্জাক বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় ইসকন সমর্থকেরা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামকে ধরে নিয়ে রঙ্গম টাওয়ার এলাকায় কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ হত্যার প্রতিবাদে বুধবার আদালতে কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে।’
এছাড়া বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রামে ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আইনজীবীকে হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করে।
আরো পড়ুন : গত ২৪ ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের মৃত্যু, ২৪ ঘণ্টায় ৯৯০ জন হাসপাতালে