স্বাধীন আমরা হবই: শহীদ বাবার কথা নিয়ে লিখেছেন তাপস সরকার

ইতিহাস-ঐতিহ্য ওকে নিউজ স্পেশাল তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত মুক্তিযুদ্ধ শিক্ষা সফলতার গল্প হ্যালোআড্ডা

শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রিয় সাধন সরকার ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহের ফুলপুরে নিজ এলাকায় ছাত্র ও স্থানীয় যুবকদের অনুপ্রাণিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা যখন শহীদ হন, তখন আমার বয়স দুই বছর। বাবার স্মৃতি বা মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি আমার নেই। বাবার কথা শুনেছি আমার মা, আত্মীয়স্বজন, বাবার ছাত্র ও অন্যান্য লোকের মুখে। বাবাকে জেনেছি তাঁর লেখা বই ও অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি পড়ে। আমার বাবা প্রিয় সাধন সরকার ছিলেন একজন তরুণ কবি, নাট্যকার, শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন।

আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার পয়ারী গ্রামে। বাবার জন্ম হয়েছিল বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও নাটক লিখতেন। নিজের লেখা নাটক মঞ্চস্থ করতেন, অভিনয়ও করতেন। ১৯৬৩ সালে তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিএড প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আমাদের গ্রামের পয়ারী গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত বন্ধ হলো, তখন বাবা এলাকার মানুষদের উজ্জীবিত করতে শুরু করেন। ছাত্র ও স্থানীয় যুবকদের সংগ্রামী চেতনায় অনুপ্রাণিত করেন। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এই প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবা এলাকার লোকজন নিয়ে নিজ বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উঠিয়ে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন আমরা হবই। এমন কোনো শক্তি নেই, যা আমাদের ঠেকাতে পারে। মুক্তিকামী জনতা এক হয়ে তাদের শক্তিকে মহাশক্তিতে পরিণত করছে। জন্ম হচ্ছে স্বাধীনতার। আঘাত আসবেই। অনেক রক্ত ঝরবে। আমরা না থাকলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হবে।’

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। টাকাপয়সা দিয়ে ও নানাভাবে সাহায্য করা হতো। একটা সময় আমাদের গ্রামে রাজাকার-আলবদরদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাবা নিজে গিয়ে গোপনে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন, সহযোগিতা করতেন।

১৯৭১ সালের ১৯ জুলাইয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এমনই এক সমাবেশ ছিল বাবার। সকালে সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে যখন বের হন, তখন আমাকে কোলে নিয়ে মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবাকে সাইকেলে উঠতে দেখে আমি নাকি খুব কান্না শুরু করেছিলাম। তখন বাবা সাইকেল থেকে নেমে আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলেছিলেন, ‘সোনামণি, তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকো।’ তারপর বাবা চলে যান পেডল চেপে।

সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাবাকে তাঁর কর্মস্থলে অনুষ্ঠিত সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সঙ্গে আরও পাঁচজনকে। পরদিন থেকেই এলাকায় শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা আমাকে আর আমার দুই মাস বয়সী বোনকে নিয়ে এক কাপড়ে পালিয়ে পাশের গ্রামের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে থাকার সময়ই রাজাকাররা হানাদার সেনাদের নিয়ে আমাদের গ্রামে এসে বাড়ি বাড়ি আগুন দিয়ে লুটপাট করে। গ্রামের ছয়জন নারী আর দুজন বৃদ্ধকে গুলি করে মেরে ফেলে। তারপর আত্মীয়ের বাড়ি থেকেও মা আমাদের নিয়ে পালাতে শুরু করেন। একটা সময় হালুয়াঘাট সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাই। আমাদের ঠাঁই হয় শরণার্থীশিবিরে।

দেশ স্বাধীন হলে আমরা শরণার্থীশিবির থেকে দেশে ফিরে আসি। লোকমুখে জানা গেছে, বাবাকে ফুলপুরের সরচাপুরের কংস নদের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্মম নির্যাতনের পর পাকিস্তানি হানাদাররা বাবাসহ অন্য বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করে। এরপর তাঁদের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আমরা বাবার লাশেরও সন্ধান পাইনি।

এরপর শুরু হয় আমার মায়ের সংগ্রাম। তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস ছিলেন। চাকরি করবেন বলে স্বাধীনতার পর আবার পড়াশোনা শুরু করলেন। সংসার সামলে একে একে তিনি বিএ, এমএ পাস করেন এবং বিএড প্রশিক্ষণ নেন। এরপর স্কুলে যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। আমাদের মানুষ করার জন্য কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না করে গেছেন। জানি না আমরা দুই ভাই–বোন মায়ের সংগ্রামের প্রতিদান দিতে পেরেছি কি না।

আরো পড়ুন : আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *