ঘটনাবহুল জীবন তার। স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। জীবন সংগ্রামের নানা সব কঠিন অধ্যায়। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে হাল ধরতে হয় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র। রাজনীতিতে এসেই করেন বাজিমাত। হন তিনবার প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপিকে ভাঙার অপচেষ্টা কিন্তু কম হয়নি। দক্ষতা আর আপোসহীন নেতৃত্বে তিনি সামলে নিয়েছেন। এমনকি এক-এগারোর সময় তাকে তো জোর করে বিদেশ পাঠানোর চেষ্টাও হয়েছিল।
নীতি আর আদর্শে অটল বেগম খালেদা জিয়াকে নানান কূটচাল দমাতে পারেনি। হ্যাঁ, বেগম খালেদা জিয়া এমনই। যাকে ভুল ও সাজানো মামলায় কারাগারে পাঠানো হলেও তিনি সায় দেননি কোনো দফা-রফায়।
পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার কথায় তখন আদালত চলত। কিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার এই মানুষটিকে নিয়ে বিস্তারিত জানতে পাঠক ও দেশ-বিদেশের মানুষের তুমুল আগ্রহ এবং কৌতূহল। জানতে চান তিনি কি আগের মতো সক্রিয় হচ্ছেন? কী ভাবছেন দেশ-রাজনীতি নিয়ে। তারেক রহমান কি দেশে ফিরছেন? কী বলছেন এ নিয়ে খালেদা জিয়া। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা তাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছেন। নানা অসুখ-বিসুখে ক্লান্ত খালেদা জিয়া কেমন আছেন এখন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালানো হাসিনা তো আইনি দোহাই দিয়ে তাকে একবারো অনুমতি দেননি বিদেশ যাওয়ার। খালেদা জিয়া কি এখন তাহলে দেশের বাইরে যাচ্ছেন? গেলে কবে নাগাদ যেতে পারেন।
অতিসম্প্রতি গুলশানের ফিরোজায় বেগম খালেদা জিয়া ও মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর ঘণ্টাব্যাপী আলাপচারিতার নানা বিষয় oknews24bd.com পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হইল –
তার শরীর ভালো নেই- এটা সবার জানা। গুলশানে চার কামরার এক বাড়িতে থাকেন। বলা চলে দুই কামরাই চিকিৎসক আর নার্সের জন্য বরাদ্দ। তবে মনে জোর প্রবল। দেশ নিয়ে ভাবেন। ভবিষ্যৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এমন কি দেশ কোন দিকে যাবে- এ নিয়েও তার মধ্যে অন্তহীন ভাবনা। ফিরোজার আড্ডায় নির্মল হাস্যরস ও সিরিয়াস রাজনীতি নিয়ে ঘণ্টাখানেক তার সঙ্গে কথা হয়। সাক্ষাৎকার নয়, আলাপচারিতা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে- আগের মতো সক্রিয় হতে চান, কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শরীর। নানা অসুখ-বিসুখে তিনি ক্লান্ত। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা তাকে অনেকটাই পঙ্গু করে দিয়েছেন। তাকে কারাগারেও দিয়েছেন নানা যন্ত্রণা। ঠেলে দিয়েছিলেন মৃত্যুর মুখেও। আল্লাহ’র অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে আছেন এই মন্তব্যই করলেন। দেশের রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, বিএনপি ভাঙার কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। বরং বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারেকের অদম্য সাহস আর সঠিক নেতৃত্বে দলটাকে এক রাখা সম্ভব হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিকবার বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করেন। এক-এগারোর সরকার তো বেগম জিয়াকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। দলে অনৈক্য ও ভাঙার চেষ্টাও করা হয়। খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বেই তাদের সব চেষ্টা ভণ্ডুল হয়। এমনকি ক্ষমতায় যাওয়ার প্রস্তাবেও তিনি রাজি হননি। নীতি আর আদর্শের প্রশ্নে বরাবরই তিনি একরোখা। তার অভিধানে আপোষ নেই। এক ভুল ও সাজানো মামলায় শেখ হাসিনা তাকে কারাগারে পাঠান। এর আগে নানাভাবে চেষ্টা করেন কোনো আপোষ-রফায় খালেদা সায় দেন কি-না। কিন্তু খালেদা সে সুযোগ দেননি। আলোচনা ও দেখা সাক্ষাতের সুযোগও ছিল বন্ধ। আদালত চলতো হাসিনার কথায়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটি ছিল হাস্যকর। প্রথমে পাঁচ বছর জেল হয়। উচ্চ আদালত আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেয়। যা কিনা এক নজিরবিহীন ঘটনা। টাকা তিনি সরাননি। বরং টাকা তিনগুণ হয়েছে। তবে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা থেকে তিনি খালাস পান।
কেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা? অনুসন্ধান বলছে, হাসিনার পাতানো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই এই মামলা দেয়া হয়। সীমাহীন নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে তার দিন কেটেছে কারাগারে। একই অবস্থা ছিল ফিরোজায়। চার দেয়ালের বাইরে কী ঘটছে তা জানতে পারতেন না। বারবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। হাসিনার প্রতিহিংসা এমনই ছিল যে, তার আত্মীয়স্বজনরাও কখনো কখনো ফিরোজামুখী হতে পারতেন না। ওষুধ সেবনের সময় থাকতে হতো সতর্ক। বহু চেষ্টা হয়েছে তাকে দৃশ্যপট থেকে বিদায় দেয়ার।
উল্লেখ্য, তার জীবন ঘটনাবহুল। সত্যই একজন আলাদা রাজনীতিবিদ। ব্যবসায়ী পিতার কন্যা, সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যুক্ত হোন বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা ঘটনা প্রবাহে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে অল্প বয়সে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করতে না করতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয়। যদিও তখন তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র হাল ধরেন অনেকটাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কিন্তু আপোষহীন এই নেত্রী রাজনীতিতে এসে বাজিমাত করেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রীও হন।
যাই হোক, দীর্ঘদিন নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগলেও এখন আগের তুলনায় অনেকটা ভালো। যদিও হাঁটা-চলা প্রায় অসম্ভব। নার্সের সহায়তায় বেডরুম থেকে ড্রইংরুমে আসেন। সীমিত ভিজিটরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তবে বিলেতপ্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা হয় নিয়মিত। জানতে চান, দেশ- দুনিয়ার খবরাখবর। আত্মীয়-স্বজনরাও নিয়মিত যান। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হয়। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে তার মুখোমুখি হতে হয়। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আইনি দোহাই দিয়ে হাসিনা একবারও অনুমতি দেননি। লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কের চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। সম্ভবত প্রথমে কাতার হয়ে লন্ডন যাবেন। এরপর নিউ ইয়র্ক। এ মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের শুরুতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সামনে বড়দিন। এই সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তাই বিলম্ব হচ্ছে এমনটাই বললেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার সাড়ে পনের বছরের শাসনের পতনের পর খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ হয়। ন্যায়বিচারে তার বিরুদ্ধে আনা একাধিক মামলা থেকে খালাস পান। তারপরও কোথাও যাননি। সংশ্লিষ্ট সবার অনুরোধে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে যান তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রী। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শেখ হাসিনা তাকে ঘরছাড়া করেন। এরপরও তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। শেষ বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন। অথচ জনতার বিচারে হাসিনাই এখন দেশ-ছাড়া। শত শত হত্যা মামলা এখন তার বিরুদ্ধে। ভারতে আশ্রয় নিয়ে হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাবার নেশায় বিভোর। কিন্তু ইতিহাস তো তা বলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো স্বৈরশাসকের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। মিরাকল কিছু না ঘটলে হাসিনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তার আশ্রয়দাতা ভারত এখন উল্টো সুরে কথা বলছে। তারা বলছে, হাসিনার কথা বা বিবৃতিতে তাদের কোনো সায় নেই। কথা প্রসঙ্গে অনেক বিষয়েই খালেদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ৭৯ বছর বয়সী খালেদা শুধু শুনলেন। তেমন কোনো মন্তব্য করলেন না। দু’একটা বিষয়ে মতামত দিলেও কাউকে আঘাত করে নয়। খালেদার বিউটি হচ্ছে তিনি শুনেন বেশি, বলেন কম। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার জবাব দিতে বরাবরই ছিলেন সতর্ক। আলাপচারিতার একপর্যায়ে বললেন, দেশটাকে হাসিনা কোথায় নিয়ে গেছে। অর্থনীতি পঙ্গু। নিজের দেশ নিজেই লুট করেছে। রাজনীতি নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভয় আর আতঙ্কে মানুষ ছিল একদম কাবু। মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অসম্মান করার নেশা হাসিনাকে পেয়ে বসেছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশটাকে বাঁচিয়েছে। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হলে দরকার জাতীয় ঐক্যের।
আপনি কী আবার সরব হবেন? শরীর তো আমাকে সায় দেয় না। দল তো এখন ভালোই চলছে। এসময় তারেক রহমানের প্রশংসাও করলেন। তারেক রহমান কি সহসাই দেশে ফিরবেন? আমার বিশ্বাস সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে তারেক। অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। বললেন, দেশে এসে থাকবেই বা কোথায়? দেখতেই তো পাচ্ছেন আমি কীভাবে থাকি! শেষ পর্যায়ে আতিথেয়তা দেখে আমি নিজেই বিমোহিত। কোনো কমতি নেই। অনেকক্ষেত্রে বেশি। কোনটা নেবো সেদিকেও তার দৃষ্টি। একদিন খেলে কিছু হবে না- এমনটাও বলতে কসুর করলেন না। এটাকেই বলে মানুষের প্রতি নির্মোহ দরদ আর ভালোবাসা।
আরো পড়ুন : কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণার কথা শুনলেই উপদেষ্টাদের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ