মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া’র মুখে ১৯ হাজার গেরিলা ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প

ইতিহাস-ঐতিহ্য ওকে নিউজ স্পেশাল জাতীয় প্রচ্ছদ মুক্তমত মুক্তিযুদ্ধ লাইফ স্টাইল শিক্ষা হ্যালোআড্ডা

বাংলার হাজার হাজার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ঝাঁপিয়ে পড়েন ’৭১-এর রণাঙ্গনের জনযুদ্ধে। জননেতা মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মস্কোপন্থি ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফরের গেরিলা বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে রণাঙ্গন থেকে হটিয়ে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখে।

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে গা এখনও শিউরে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলন যখন ঘোষণা হয় তখন আমি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সরকারি চাকরিতে কর্মরত। সেই চাকরি ছেড়ে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট থেকে মৌলভীবাজার তিতাস নদী হয়ে সিংগারবিল সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করে বাসযোগে আগরতলায় যাই। সেখানে চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ন্যাপনেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অন্য সকল বাম দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়। আগরতলায় স্থানীয় একটি কলেজের দোতলায় গেরিলা ক্যাম্প স্থাপন করি। সবাই মিলে সংগঠিত হয়ে গেরিলা ও সশস্ত্র যুদ্ধের রণকৌশল শিখে বিলোনিয়ার রণাঙ্গনে আসি।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসামান্য অবদান রেখেছেন। কারণ, এ বাহিনী ছিল পলিটিক্যাল, সংগঠিত ও নিবেদিত। যুদ্ধের শুরুতে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমরা এ বাহিনী গড়ে তুলেছি। এ বাহিনী গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতিকে পরিবর্তন করেছে। এ বাহিনী কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে সম্পৃক্ত করে বাঙালি ও বাঙালি জাতির এ যুদ্ধকে গণযুদ্ধে রূপ দিয়েছিল। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে ১৯ হাজার গেরিলার এ বিশাল বাহিনী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গর্ব। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২০১৩ সালে ২৩৩৭ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সরকারি গেজেটভুক্ত হলেও এখনও আমাদের অনেক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হতে পারেননি। এটি খুবই দুঃখজনক।

দুঃখ লাগে তখনই, যখন দেখি জীবনবাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেও সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। অন্যদিকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও সনদ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, সঠিকভাবে তদন্ত করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ছিল সর্বজনীন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ গণযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। একক কোনো বাহিনী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এ যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল গেরিলা প্রকৃতির। কারণ, পাকিস্তানের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বাংলাদেশের এ ট্রেনিংবিহীন মুক্তিফৌজের মোকাবিলা করে টিকে থাকা মোটেই সম্ভব ছিল না। শুধু গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে এ বিজয় সহজতর হয়েছে। আমরা কখনও কৃষক, জেলে, কামার, শ্রমিক, ভিক্ষুকসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ করতাম। দীর্ঘ ৯ মাস এভাবে যুদ্ধ করে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হত্যা করা হয়।

ওই সময় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রামের জনগণ খাবার সংগ্রহসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমার বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার তৎকালীন আনন্দপুর ইউনিয়ন বর্তমান জি এম হাট ইউনিয়নের বসিকপুর গ্রামে। আমার বাবা সেকান্তর ভূঁইয়া আমার জন্য ২৪ কাঠা ধান ও ১১টি টিন পাঠিয়েছেন। ওই ১১টি টিন দিয়ে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার দেবপুর বিডিআর ক্যাম্পের বিপরীতে ভারতে আমতলী বাজারে গুণধর দাসের বাড়িতে ঘর তৈরি করে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অবস্থান করতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পাকাবাড়িতে নিরাপদের জন্য গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতেন। তাতেও ঝুঁকি ছিল পাকিস্তানি সেনারা ওই পাকাবাড়ি লক্ষ্য করে মর্টার শেলসহ বিভিন্ন ভারী গোলাবারুদ নিক্ষেপ করত। পরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা কুঁড়েঘর ও ছনের ঘরে অবস্থান করে যুদ্ধের কার্যক্রম চালিয়েছেন। গেরিলাদের রণকৌশলে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে বাধ্য হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছেন মনে করে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে মর্টার শেল ও ভারী গোলাবারুদ নিক্ষেপ করেছে। তৎকালীন আনন্দপুর ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেনের পাকাঘরের পিলারে মর্টার শেল পড়লে ঘরের পিলার ভেঙে যায়। সেই স্মৃতি এখনও সবার মনে আছে। কখন নিজের শরীরে অথবা ঘরের ওপর বোম পড়ে এ নিয়ে সবাইকে আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করতে হয়েছে। তারপরও যুদ্ধ থেমে থাকেনি।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ৩৪টি জেলার মধ্যে ফেনী জেলার বিলোনিয়া রণাঙ্গন ছিল অন্যতম। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ফেনী জেলা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফেনী ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ফেনী জেলাকে বলা হতো একাত্তর মুক্তিযুদ্ধের গেইট। কারণ-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীসহ অন্যান্য জেলার যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে ভারতের আগরতলায় যেতে হয়েছে। তা ছাড়া এই রণাঙ্গনের তিন পাশ উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে ছিল ভারত। তাই পাকিস্তান সরকার তাদের রণকৌশলে ফেনীর বিলোনিয়াকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন এলাকা হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য সামরিক দিক থেকে বিলোনিয়ার যুদ্ধ উভয়ের জন্য ছিল একটি মর্যাদার লড়াই।

ছয় ডিসেম্বর যে ফেনী শত্রুমুক্ত হবে তা ভারতের আগরতলা ও বিলোনিয়ায় অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ চিন্তাও করতে পারেননি। আমরা খবর পেলাম ১ ডিসেম্বর থেকে কিছু পাকিস্তানি সেনা ঢাকার দিকে রওনা করেছে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, তাদের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তখন আমাদের যারা মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা, বিলোনিয়াতে ছিলেন এবং বিভিন্ন গ্রামে গেরিলা বাহিনীতে ছিলেন, আমরা সবাই বুঝতে পারলাম তাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। এক তারিখ থেকে আমরা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকি। ছয় তারিখ তাদের সম্পূর্ণরূপে পতন ঘটিয়ে ফেনীতে বিজয় মিছিল করি। মূলত এক ডিসেম্বর থেকে ফেনী মুক্ত হতে থাকে, যার সমাপ্তি ঘটে ছয় ডিসেম্বর। ছয় ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হওয়ার পর জেলার সব উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে বিজয় মিছিল করে ফেনীতে আসি। আমাদের ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলার প্রায় দেড় হাজার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর রাতের ঘুমকে হারাম করে বিলোনিয়া রণাঙ্গনকে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই আজ চিরতরে চলে গেছেন। যাদের আত্মত্যাগে এ দেশ স্বাধীন হলো তাদের প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম ও ভালোবাসা।

আরো পড়ুন : শেখ হাসিনা পরিবারের ৫ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতি অনুসন্ধানে রুল

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *