মাসুদের ‘মা’কে সান্তনা দিতে গিয়ে শোকাহত হচ্ছেন স্বজনরা

ওকে নিউজ স্পেশাল জাতীয় পুরুষ পুরুষ অধিকার প্রচ্ছদ মুক্তমত শিক্ষা হ্যালোআড্ডা

টেবিলের উপর রাখা কম্পিউটার, এয়ারপড। পাশের আরেক টেবিলে পড়ে আছে বই-খাতা, কলম, মোবাইলের চার্জার। চেয়ারের উপর লুঙ্গি টাওয়াল। কোথাও পরনের শার্ট, প্যান্ট পড়ে আছে। বিছানাটাও ফাঁকা। সবকিছু আগের মতো থাকলেও নেই শুধু মাসুদ। চেকপোস্টে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদের গ্রিন রোডের বাড়ির বেডরুমে গিয়ে গতকাল এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতির কমতি না থাকলেও চারদিকে ছিল মাসুদের শূন্যতা। সবার চোখের কোনায় জল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা রাইসা সুলতানা। তিনদিন ধরে তিনি কিছুই মুখে দিচ্ছেন না। স্বজনরা তাকে সান্ত্ব্তনা দিতে গিয়েও ক্লান্ত। যারা সান্ত্বনা দিচ্ছেন তারাও শোকাহত।

অন্যান্য দিনের মতোই গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল নিয়ে বুয়েটের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন ছেলে মাসুদ। দিন গড়িয়ে রাত হলেও ছেলে ফিরেনি বাসায়। মায়ের চিন্তা বাড়ছিল। ছেলে বাড়ি ফিরছে না কেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে ফোন করেন মা। ফোন রিসিভ করে মাসুদ মাকে জানায় বন্ধুদের সঙ্গে আছে। কিন্তু ভোরে একটি ফোনকলে ছেলের মৃত্যুর খবর পান মা। সেই যে তার মনে ধাক্কা লেগেছিল সেটি তিনদিন ধরেই বয়ে বেড়াচ্ছেন। শনিবার নিহত মাসুদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার রুমে তার ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র পড়ে আছে। তার মা কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। শুধু মাসুদের কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে বলছেন, আমার বাবা আর কখনো কম্পিউটারের সামনে বসে আমাকে চা বানিয়ে আনতে বলবে না। বুকচাপা কষ্ট নিয়ে বলছিলেন বাবা আমি শিগগিরই তোমার কাছে চলে আসবো।

বাবা মাসুদ মিয়া বলেন, আমার ছেলে এত বড় হওয়ার পরও প্রতিদিন আমার কপালে এসে চুমু দিতো, জড়িয়ে ধরতো, আর বলতো বাবা তোমার কপালে চুমু না দিলে আমি মনে শান্তি পাই না। শেষ যখন বাসা থেকে বের হয়ে যায় তখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো বাবা আমি বের হচ্ছি। আমার ছেলেটা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল, ছোটবেলা থেকেই তার কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল। প্রথমে সে এমআইএসটি তে চান্স পেয়েছিল, এরপর বুয়েটে সিএসি বিভাগে চান্স পাওয়ায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল। সে খুব কম বাসা থেকে বের হতো। আমার ছেলেটা কখনো কারও সঙ্গে বেয়াদবি করেনি। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে তার ওপর আমাদের অনেক আশা-ভরসা ছিল। কিন্তু এখন আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। আমরা কি নিয়ে বাঁচবো, কিসের আশায় বাঁচবো? তিনি বলেন, পরিবারের অন্যান্যদের শান্ত রাখতে ঘরে আমি কান্না করতে পারি না, বাইরে গিয়ে কান্না করতে হয়। পুলিশের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুলিশ যদি রাত ৩টায় রাস্তার মাঝখানে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক না করতো তাহলে আমার ছেলেটা আজকে বেঁচে থাকতো। পুলিশ অপেশাদারি আচরণ করে রাস্তার সাইডে তাদের না নিয়ে রাস্তার মাঝখানে মোটরসাইকেলের কাগজপ্‌ত্র চেক করার জন্য মোটরসাইকেলটিকে থামিয়েছে। এ সময় প্রাইভেটকারটি এসে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলের কবরটা যেন স্থায়ী করা হয়। যেইখানে কবর দেয়া হয়ছে ওই জায়গাটা যেন সরকার স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেয়। আমাদের একমাত্র চাওয়া সুষ্ঠু বিচার। যারা যারা এ ঘটনায় যুক্ত ছিল, তাদের যেন উপযুক্ত বিচার হয়। হুমকি পাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধীর বাবা ক্ষমতাবান হওয়ার কারণে পুলিশ মামলা নিতে প্রথমে গড়িমসি করেছে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য আমাদের চাপ দেয়া হয়েছিল। এখনো আমার ফোনে বিভিন্ন নম্বর থেকে কল দেয়া হচ্ছে, আমি ভয়ে কল রিসিভ করি না।

উল্লেখ্য, গত ২০শে ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে পূর্বাচল ৩০০ ফিট এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত হন বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদ। এ ঘটনায় আরও দুইজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। আহত দু’জন মেহেদী হাসান খান (২২) ও অমিত সাহা (২২) একই বিভাগের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

আরো পড়ুন : অস্ত্রবাজরা উধাও, কিন্তু সিলেটের এত অস্ত্র গেল কই?

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *