ঢাকার রেস্টুরেন্ট নামের মৃত্যুকূপেই চলছে খানাপিনা আর আড্ডা

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আইন-আদালত ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

♦ ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, নেই বিকল্প বহির্গমন পথ

♦ সংকুচিত সিঁড়ি ছোট লিফট

♦ নিরাপত্তা নিশ্চিতে পরিদর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ

পরিবার-পরিজন ও প্রিয়জনদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খানাপিনা, সেলফি তোলা, একটু আড্ডা দেওয়া ঢাকাবাসীর কাছে এখন অন্যতম বিনোদন। রাজধানীর যত্রতত্র তাই রেস্টুরেন্টের ব্যবসার প্রসার। কিন্তু এর বেশির ভাগেরই নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা।

চলতি বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের একটি ভবনের রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর নয় মাস না যেতেই গত ২০ ডিসেম্বর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের লাভলীন নামের একটি রেস্টুরেন্টে আবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় কারও মৃত্যু না হলেও কয়েকজন আহত হন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর ৯৯ শতাংশ রেস্টুরেন্ট ভবনেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। এই রেস্টুরেন্টগুলো এখন এক-একটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন না নিয়েই ব্যবসা চালিয়েছে উত্তরার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত লাভলীন রেস্টুরেন্ট। এই ভবনটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এই ভবনটিতে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। এর ছিল না পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের যে ছয তলা ভবনটিতে গত শুক্রবার আগুন লাগে এর নিচতলায় ছিল লাভলীন রেস্টুরেন্ট। এই ভবনটিতে যখন আগুন লাগে তখন আটকে পড়া সাতজনকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। গ্যাস লিকেজ থেকে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে। বহুতল ভবনটি আবাসিক হলেও সেখানে রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট করা একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসব রেস্টুরেন্ট বেশির ভাগ যে ভবনে অবস্থিত সেখানে একমাত্র যে সিঁড়ি থাকে সেটিও ফায়ার গ্রেডের না। যে ভবনগুলো অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সেগুলো ২০০৮-এর নীতিমালার আগে তৈরি হয়েছে। এজন্য পুরনো ভবনগুলোকে ফায়ার স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসতে হবে। যেমনটি পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতারা দেশের কারখানা মালিকদের কারখানাগুলোকে ফায়ার স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে বিদ্যমান ভবনে। অনেকে আবার বাণিজ্যিক ভবনে রেস্টুরেন্ট করেছেন। এসব রেস্টুরেন্টে নেই বিকল্প বহির্গমন পথ। যে লিফট আছে তা ছোট এবং সিঁড়িগুলোও বেশ সংকুচিত। দুঃখজনক যে, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীর রেস্টুরেন্টগুলো পরির্দশন করা হলেও কয়েকদিন যেতেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।

স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, ঢাকার অনেক রেস্টুরেন্টে এখন সিএনজি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টি দেখতে হবে। নগরীর পুরান-নতুন ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নকশায় নিরাপত্তার বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলেও কার্যকরভাবে তা নেই। এগুলো দেখার জন্য একটি থার্ড পার্টি ইন্সপেকশন লাগবে। যেভাবে অ্যাকোর্ড-অ্যালায়েন্স দেশের পোশাক কারখানাগুলো ঠিক করল সেভাবেই দেশের রেস্টুরেন্টগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এই থার্ড পার্টি স্থানীয় হলে দুর্নীতির আশঙ্কা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে পরিদর্শনে বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোকে কাজ দেওয়া যেতে পারে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল গতকাল বলেন, আমাদের ফায়ার ইন্সপেক্টররা প্রায়ই রেস্টুরেন্টগুলো পরিদর্শন করেন। রেস্টুরেন্টগুলোয় যদি অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে রেস্টুরেন্ট মালিকদের নোটিস দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত দেশব্যাপী ২ হাজার ৩৮টি রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে যাদের নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা আছে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো হয়েছে। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্টগুলো চিহ্নিত করেছি। উত্তরার ভবনটিকেও নোটিস দেওয়া হয়েছিল। আমরা এরই মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় প্রশাসন থেকে নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, দেশের রেস্টুরেন্টগুলো আইন মেনে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকি যে সংস্থাগুলোর করার কথা তারা এ ব্যাপারে উদাসীন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি যে, পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ-এর আদলে আমাদের সংগঠন চালাতে চাই। এর মাধ্যমে সব রেস্টুরেন্টগুলো আমরা নজরদারি করতে পারব। এতে কোনো ব্যবসায়ী যাতে কমপ্লায়েন্সের বাইরে ব্যবসা করতে না পারেন তা নজরদারি করা যাবে। কিন্তু এখানে যে যেভাবে পারছে রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা করছে।

আরো পড়ুন : মেঘনা নদীতে সারবোঝাই জাহাজে সাত লাশে রহস্য

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *