প্রাণঘাতী অস্ত্র কমিয়ে শর্ট ব্যারেল অস্ত্র এবং স্থায়ী পুলিশ কমিশনের সুপারিশ

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আইন-আদালত ওকে নিউজ স্পেশাল জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি নির্বাচন প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

পুলিশে দুই স্তর নিয়োগ, প্রাণঘাতী অস্ত্র কমিয়ে শর্ট ব্যারেল অস্ত্র এবং স্থায়ী পুলিশ কমিশনের সুপারিশ করা হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ‘পুলিশ কমিশন’-এর স্থায়ী রূপ দিতে সংবিধান এবং নতুন আইনের প্রস্তাব করা হবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। অন্যদিকে, প্রতিবেদনে উঠে আসছে মানবাধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পুলিশে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে জোর দেওয়ার বিষয়টি। এ ছাড়া উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বলপ্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদন্ড বা নীতিমালা অনুসরণের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। ইতোমধ্যে খসড়া প্রতিবেদন প্রস্তুত হলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে সরকারের কাছে আরও দুই সপ্তাহ সময় চাওয়া হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক পুলিশ সংস্কার কমিশনের অনলাইন জনমত জরিপে মোট ২৪ হাজার ৪৪২ জন মতামত দিয়েছেন। জরিপে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চেয়েছেন। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জরিপে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে চরম মানবিকতার লঙ্ঘন বিবেচনায় অপরাধী পুলিশকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা। ভুয়া বা গায়েবি মামলার অপসংস্কৃতির সংস্কার চান শতকরা ৯৫ জন।

পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাহী বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা নিরসনের সুপারিশ করা হবে আমাদের প্রতিবেদনে। কে ছোট আর কে বড় এই বিষয়টি ঘোচানো সম্ভব না হলে কাজের সমন্বয়ে সমস্যা হয়।

জানা গেছে, পুলিশের জন্য ১৭ বার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এবার ১৮ বারের মতো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কারে সহায়তার প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকেও তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের ওপরও জোর দিয়েছেন। এ ছাড়া বলপ্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মতিউর রহমান শেখের নেতৃত্বে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল সংস্কার কমিশন। পুলিশ কর্মকর্তারা দুই স্তরে পুলিশ নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। তারা বলেছেন, কনস্টেবল নিয়োগে যোগ্যতা থাকবে এইচএসসি। নিয়োগ-পরবর্তী মৌলিক প্রশিক্ষণের পর তারা দুই থেকে তিন বছর পুলিশে কাজ করবেন। এর পর কমপক্ষে তিন বছর মেয়াদি স্নাতকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। সেখানে তাদের জন্য থাকবে আলাদা সিলেবাস। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি করা যেতে পারে। পরে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিষয়ে মতামত দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। মানবাধিকার এবং পুলিশিংয়ের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হবে কোর্সগুলোতে। স্নাতক পাসের পর তারা সাব-ইন্সপেক্টর পদে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত হবেন। এএসপি পদের জন্য চলমান পদ্ধতিই অনুসৃত হতে পারে। এ ছাড়া পুলিশে প্রাণঘাতী অস্ত্র কমিয়ে শর্ট ব্যারেল অস্ত্রের বিষয়ে মতামত দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যকে অবশ্যই তাদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে এবং তার স্বজন কিংবা আইনজীবীকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। অভিযানে প্রাণঘাতী অস্ত্র কমিয়ে শর্ট ব্যারেল অস্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দেওয়া মতামতে অনেকটাই একমত পোষণ করেছেন কমিশনের সদস্যরা।

জানা গেছে, এর আগে পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে একটি খসড়া প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। খসড়া রিভিউ করে আলাদা মতামত দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তা ফের সংস্কার কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পাঁচটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে জবাবদিহিমূলক জনমুখী পুলিশ বাহিনী গড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পুলিশ আইন, পিআরবিসহ অন্যান্য বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার চাওয়া হয়েছে। পুলিশের বাজেট বৃদ্ধি ছাড়াও ফোর্সের ব্যবস্থাপনা, গ্রেপ্তার, আটক, তল্লাশি, জব্দসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন গাইডলাইন প্রণয়নেরও প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পুলিশের সব ধরনের দাবি-দাওয়া কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমেই উচ্চপর্যায়ে পাঠানোর বিধান রাখতে হবে। তাহলে বিদ্যমান অনেক অদৃশ্য জটিলতার নিরসন হবে।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি। আশা করছি, কমিশন আমাদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

পুলিশ বাহিনীকে সঠিক দিকনির্দেশনা, পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে চেয়ারম্যান করে একটি পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাবসহ মোট ১৭ দফা প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে। কমিশনে আরও কারা থাকবেন তাও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়তে এবং মানবাধিকারের প্রতি আরও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পুলিশের অযৌক্তিক সহিংস বলপ্রয়োগ এবং নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ কর্তৃক বেআইনিভাবে আটক, গ্রেপ্তার, তুলে নিয়ে অস্বীকার করা, যতদিন খুশি আটক ও গুম করে রাখার ঘটনার অবসান ঘটাতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।

জানা গেছে, উন্নত দেশগুলোর মতো ৮ ঘণ্টার বেশি সরকারি দায়িত্ব পালন করলে ওভারটাইমের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এই সুপারিশটি করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশকে ‘পেটুয়া’ বাহিনীর ইমেজ থেকে বের করে আনতে হবে। একই সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি যাতে পুলিশকে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

জানা গেছে, পুলিশ সংস্কারে গঠিত কমিশনের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি, পুলিশ বাহিনী ছাড়াও বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা নানা সুপারিশ দাখিল করেছে। এসব সুপারিশে সব পক্ষই পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার প্রস্তাব করেছে। ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়ে খোদ সংস্কার কমিশন একমত হলেও এর প্রধান কে হবেন, এর সুপারিশ নিয়ে তাদের মধ্যেও মতদ্বৈধতা রয়েছে। তবে কমিশনের সদস্যরা কারা হতে পারেন সে বিষয়ে তারা একমত পোষণ করেছেন।

সংস্কার কমিশনের জরিপে, বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি চেয়েছেন ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ (প্রায়) উত্তরদাতা। ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিস্থাপিত প্রমিত পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণকে প্রবিধানভুক্ত করার পক্ষে মত দেন। জরিপে পুলিশকে জবাবদিহি ও বিভিন্ন প্রভাবমুক্ত রাখতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কমিশনের পক্ষে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মত দেন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নাসির উদ্দীন এলান বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়তো প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে না। আরও দুই সপ্তাহ বেশি সময় লাগতে পারে।

আরো পড়ুন : দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *