সিলেট বিভাগে হঠাৎ বেড়েছে খুনোখুনি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘটছে খুনের ঘটনা। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। ছোটখাটো ঘটনায় খুনের মতো জঘন্য অপরাধ ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। গত কয়েক দিনে সিলেটে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।
গত ৯ এপ্রিল সিলেট ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেটের সামনে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় হোটেল শ্রমিক নাজিম আহমদকে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রকাশ্যে তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান নাজিম। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে নাজিমকে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা নুর মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেছেন। আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।
৫ এপ্রিল জৈন্তাপুর উপজেলায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জমি-সংক্রান্ত বিরোধ থাকলেও কথা কাটাকাটি নিয়ে দুই গ্রামবাসী একজোট হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দু’পক্ষের সংঘর্ষ থামাতে মধ্যস্থতা করতে যান মাওলানা সালেহ আহমদ। এ সময় প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন তিনি। পুলিশ গ্রামবাসীর এই সংঘর্ষ থামাতে ৩৫৮ রাউন্ড শটগানের গুলি ও ৫৮ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। আহত হন পুলিশের সাত সদস্য।
এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আটজনকে আটক করা হয়েছে।
৮ এপ্রিল জুমার নামাজের সময় বড়লেখা সদর ইউনিয়নের কেছরিগুল জামে মসজিদে জামাল আহমদের সঙ্গে বড়লেখা সদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সরফ উদ্দিন নবাবের কথা কাটাকাটি হয়। পরে এলাকার লোকজন বিষয়টি সমাধান করে দেন। তবে আসরের নামাজের সময় জামালের ছেলে ও ভাতিজাদের সঙ্গে ইউপি সদস্য সাবুল আহমদের ভাই সরফ উদ্দিন নবাবের ছেলে ও ভাতিজাদের ঝগড়া হয়। ওই দিন জামালের পক্ষের লোক ভেবে রুবেল আহমদ নামে একজনকে আটকে রেখে মারধর করেন ইউপি সদস্য সাবুল ও তার ভাই নবাব। এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয় রুবেলকে। গুরুতর আহত রুবেলকে বাঁচাতে গিয়ে তার ভাই সুমন আহমদও আহত হন। পরে স্থানীয়রা রুবেলকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বড়লেখা থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বলেন, সামান্য কথা কাটাকাটির কারণে এই খুনের ঘটনা। স্থানীয়ভাবে সমাধান হওয়ার পরও এ ঘটনা ঘটে। এতে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেটের সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি ও সিলেট সুজনের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গত কয়েক দিনের পত্রিকা এবং অনলাইন ঘাঁটলে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, সেটি হলো খুন। আর এসব খুনের ঘটনা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় এসব ঘটনা প্রতিরোধে আগে পারিবারিক শিক্ষা প্রয়োজন। এটা অভিভাবকদের কাছ থেকে শিখতে হবে। আর ছোটবেলার ভালো অভ্যাসটাই বড় হওয়ার ক্ষেত্রে কাজে দেয়।
মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সিলেট নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ডা. সিদ্ধার্থ পাল বেশ কয়েকটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আমরা যে সমস্যা ঘরে বসেই সমাধান করতে পারি, সেটি গড়াচ্ছে রাজপথের খুনে। যেটি যুক্তিতর্ক দিয়ে সমাধান সম্ভব, সেটি শেষ হচ্ছে শক্তি দিয়ে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, মানুষের মনের ওপর যখন বিরূপ প্রভাব পড়ে, তখনই মানুষ খুনের মতো ঘটনা ও উগ্র আচরণ করে। এজন্য প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা।
সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলছে, এ অঞ্চলে তুচ্ছ কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটে। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, পারিবারিক কলহেও খুনের ঘটনা ঘটে। আমাদের মধ্যে এখন আর আগের মতো পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন নেই। আপনজনের প্রতি আস্থা, মূল্যবোধ নেই। কেউ কাউকে সাহায্য করতে চান না। তিনি বলেন, শুধু আইনিভাবে শাস্তি দিয়ে এই অপরাধমূলক কাজ থেকে মানুষকে ফেরানো যাবে না। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরো পড়ুন : রিকশাচালক সেজে ১৫ মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ