সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মারা গেলেন ৮৮ বছর বয়সে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকালীন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। টানা দশটি বাজেট দেওয়ার বিরল রেকর্ডও তাঁর দখলে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কথা বলতেন। প্রশ্নটি সঠিকভাবে করতে পারলে তিনি উত্তর দিতেন, এড়িয়ে যেতেন না। সাফল্যের কথা যেমন বলেছেন, ব্যর্থতাও লুকাননি, ক্ষোভের কথাও বলতেন। কোনো কিছু পছন্দ না হলে ‘রাবিশ’ বলতেন কেবল, এর বেশি কিছু নয়। তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংক, আর্থিক খাত, কালোটাকা—সব বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন। এ ধরনের পাঁচটি বিষয় নিয়ে মনে রাখার মতো ও গুরুত্বপূর্ণ উক্তি নিয়েই এ আয়োজন।
১. বৈধতার খোঁজে দুর্নীতি ও দুঃশাসন
প্রথম উক্তিটি অবশ্য বেশ আগের। আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২ সালের ২৯ মার্চ তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। এ নিয়ে তিনি পরে লিখেছিলেন, ‘২৯ মার্চ নানা চাপের মুখে আমি নিতান্তই একটি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। জীবনের এই সর্বপ্রধান ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।’ তিনি এরশাদের সঙ্গে ২১ মাস ছিলেন। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে লিখতে শুরু করেন। সেই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। প্রথম উক্তিটি ‘বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য’ বই থেকে নেওয়া। এরপর অনেকটা সময় পার হয়েছে। তিনি আবার অর্থমন্ত্রী হন। তারপরও পড়লে মনে হবে কথাগুলো সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।
আবুল মাল আবদুল মুহিত লিখেছিলেন, ‘যে সরকার বৈধতা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাকে গ্রামীণ মাতব্বরদের খুশি করতে হয়, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের হাত করতে হয়, শিল্পপতিদের সুযোগ দিতে হয়, আমলাদের ক্ষমতা দিতে হয়, রাজনীতিবিদদের দলে টানতে হয় অথবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খাতির করতে হয়। এ অবস্থায় সরকারি তহবিলের যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচয় অবধারিত। এই রকম সরকার আর্থিক শৃঙ্খলা বা প্রশাসনিক নিয়মকানুনের থোড়াই তোয়াক্কা করে। বাংলাদেশে ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করাটা এখন এক রকম সার্বজনীন অভ্যাস। বড় বড় ব্যবসায়ী, সফল শিল্পপতি বা গ্রামীণ মাতব্বর কেউই ঋণ পরিশোধ করে না। তার ফলে উদ্যোগী লোকেরা বা গরীব চাষীরা কোন ঋণ পায় না, সুস্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না। শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ঋণ বা কৃষিকর্মের জন্য ঋণ পাওয়া এখন বস্তুতই ভাগ্যের ব্যাপার। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ব্যক্তিরা গোষ্ঠী হিসেবে সরকারের সহযোগী, তাই এদের মর্জিই হলো সরকারের প্রচেষ্টা। বিশেষ গোষ্ঠীকে নিজের দলে রাখতে গেলে স্বভাবতই দেশের বা জনতার স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়। মোটরগাড়ি বাংলাদেশে বড়লোকের ব্যবহারের সামগ্রী। এর আমদানি থেকে সরকার অনেক শুল্ক আদায় করে। ভোট চুরি করে বা বিনা ভোটে যারা সংসদ সদস্য হয়েছে, সরকারের এই সব দোসরের গাড়ি আমদানির জন্য কিন্তু কোন আমদানি শুল্ক নেই।’
২. রাজনীতি আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল
নতুন করে অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরে আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম বাজেট। বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১১ জুন। এর আগে তিনি বেশ কয়েকবার কালোটাকা নিয়ে কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, বাজেটে কালোটাকা সাদা করার কোনো সুযোগ থাকবে না। কিন্তু ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ঠিকই এই সুযোগ রাখা হয়েছিল। বাজেটের পরদিন অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্নের ঝড়ের মুখে পড়েছিলেন তিনি। তবে সামলেছিলেন নিজের মতো করেই। এড়িয়ে যাননি, ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেই ব্যাখ্যা সরকারের অনেক পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনের কারণ বলে এখনো ধরে নেওয়া যায়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত সেদিন বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়। আর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্যও নয়। তবে রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরনের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়। ফলে দুঃসাহসিক অভিযানে না নেমে ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই শ্রেয় হয়ে পড়ে।
৩. নতুন ব্যাংকের অনুমোদন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার
একটি ব্যতিক্রম বাদে সরকার পরিবর্তন হলেই নতুন সরকার এসে নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। ব্যতিক্রমটি হচ্ছে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এলে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে তিনি আর ব্যাংকের অনুমোদন দেবেন না। ওই পাঁচ বছরে নতুন ব্যাংক আর দেওয়া হয়নি।
২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর আবারও নতুন ব্যাংক অনুমোদনের প্রসঙ্গ আসে। সরকারের কাছে অনেক আবেদন জমাও পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন ছিল নতুন ব্যাংক দেওয়া ঠিক হবে না। তারপরও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কথা বলেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১১ সালের ২৪ জুলাই অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের ফোরাম-ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকার বেসরকারি খাতে আরও কিছু নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার পক্ষে। তবে কয়টা ব্যাংক লাইসেন্স পাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ ব্যাপারে তথ্য–উপাত্ত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি রাজনৈতিক কারণে হতে পারে, আবার না–ও হতে পারে।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য আরও অনেক পরে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু কথা বলেছিলেন। তখন নতুন আরও চারটি ব্যাংক দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর সেই ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। এরপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদনে সুপারিশ করতে বাধ্য হয়েছি। এভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ায় আমি খুবই অখুশি (ভেরি আনহ্যাপি)।’
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘এ সময় নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার দরকার ছিল না। তবে পলিটিক্যাল গ্রাউন্ডে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে একজন সাবেক মন্ত্রীকে ব্যাংক দেওয়ার অভিজ্ঞতাও ভালো নয়।’
৪. ফারমার্স ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবে মরতে দেওয়া উচিত ছিল
যে মন্ত্রীর কথা বলেছিলেন, তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ফারমার্স ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছিলেন। সেই ব্যাংক নিয়ে পরে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়, তা আর্থিক খাতে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। ব্যাংকটি দেউলিয়া অবস্থায় চলে গেলেও সরকার ব্যাংকটিকে আরেকজনের মালিকানায় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। নাম বদলে ফারমার্স ব্যাংক এখন হয়েছে পদ্মা ব্যাংক।
সিলেটে এক অনুষ্ঠানে ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে কথা বলেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। যাঁরা এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই উদ্যোক্তা পরিচালকেরাই লুটপাট করে ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের পতন হয় না। হতে দেওয়া হয় না। ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই।’
এ বক্তব্য থেকে পরে অবশ্য সরে এসেছিলেন তিনি। তখন তিনি আর মন্ত্রী নেই। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি নিজ বাসায় আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথম আলোকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘একটা ভুল করেছি আমি। ফারমার্স ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবে মরতে দেওয়া উচিত ছিল।’ প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কেন মরতে দিলেন না?’ উত্তরে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ভয়ে, একটা মরে গেলে তার ক্রমিক প্রভাব পড়ে পুরো খাতে। এখন মনে হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংককে মরতে দিলে অসুবিধা হতো না। আর ফারমার্স ব্যাংকে শুরু থেকেই ডাকাতি হয়েছে। এটা কোনো ব্যাংক ছিল না।’
৫. বেসিক ব্যাংকে হয়েছে দুর্নীতি আর সোনালীতে ডাকাতি
ব্যাংক নিয়ে কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দুর্বল নজরদারিই ছিল তাঁর সময়ের বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির বড় কারণ। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি অন্যতম। জাতীয় পার্টির একজন মধ্যম সারির নেতা শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের পরেই শুরু হয় ব্যাংকটির পতন। এরপর কেলেঙ্কারির ঘটনা বের হলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন শেখ আবদুল হাই। এ নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, নিজের অসহায়ত্বের কথাও প্রকাশ করেছেন।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হয় ২০১২ সালে। এর চার বছর পরে ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু আসামির তালিকায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন না। এ নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে একাধিকবার কথা বলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সংসদে বলেছিলেন, ‘ঋণ জালিয়াতিতে শেখ আবদুল হাইর সংশ্লিষ্টতা ছিল।’ এর আগে অর্থমন্ত্রী ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে। ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’
একই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের মামলায় একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) জেলে নেওয়া হয়েছে। তিনি জেলেই মারা গেছেন। আরেক ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জেলে নেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে কোনোভাবেই জেলে নেওয়া যাচ্ছে না। এঁরা সবাই বিভিন্ন জালিয়াতির মামলার আসামি। কিন্তু তাঁরা আমাদের লোকজনের সমর্থনে রয়েছেন। এটি নিয়ে আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তবে এটা ঠিক, সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক খাতে কিছুটা আস্থার সংকট হয়েছে।
আবার এ বছরেই বাজেট আলোচনায় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে লুটপাট হয়েছে, সেটা শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি।’ জনতা ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে ২০১৬ সালেই এ এম এ মুহিত বলেছিলেন, ‘বেসিক ব্যাংকে হয়েছে দুর্নীতি আর সোনালীতে ডাকাতি’
অর্থমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরে ২০২০ সালে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গটিও এসেছিল। তখন আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘আবদুল হাই বাচ্চুর মতো একটা লোকই বেসিক ব্যাংক ধ্বংস করে দিল। আর আমরাও এতে পক্ষ (পার্টি) হয়ে গেলাম। ব্যাংকটা আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের খাতে ঋণ দিত। আমরাই শিথিল করে দিলাম। এটা ছিল একটা বড় ভুল।’