১৯৭১ সাল; বাংলাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বর্ষপঞ্জির স্বাভাবিক নিয়মে সে বছরও বাঙালি মুসলমানের জীবনে এসেছিল পবিত্র রমজান মাস। এক মাস রোজা শেষে ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পশ্চিমাকাশে উঠেছিল ঈদের (শাওয়ালের) চাঁদ। পরদিন ২০ নভেম্বর শনিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর। এমন বিবর্ণ, নিরানন্দ, বেদনাবিধুর ঈদ বাঙালি জীবনে আর কখনোই আসেনি। কেননা, এক দিকে পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যা-গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে সে সময় বিধ্বস্ত পুরো বাংলাদেশ, অপর দিকে দেশমাতৃকার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা।
একাত্তরে প্রবাসী সরকার ঈদ উদ্যাপন করেছিল কলকাতায়, খুবই সাদামাটাভাবে। মন্ত্রীদের কারও কারও বাসায় ঈদের রান্নাবান্না হয়েছিল। মন্ত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরস্পরের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেছিলেন। খুবই সাধারণ পরিসরে সরকারিভাবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা ছিল।
১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন সাংবাদিক নজরুল ইসলাম। পরে তিনি একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা শিরোনামে স্মৃতিকথামূলক বই লেখেন। সেখানে তাঁর ভাষ্য, ‘…স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে মুজিবনগরে খুব ঘটা করে ঈদুল ফিতর উদ্যাপনের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল—স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর কাছে ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানিদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্য।’
ঈদের জামাত
ঈদের নামাজের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল। ছবিটি সাপ্তাহিক জয় বাংলার ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ঈদের নামাজের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল। ছবিটি সাপ্তাহিক জয় বাংলার ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের সদর দপ্তরে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। খুবই সাধারণভাবে আয়োজিত এ জামাতে ইমামতি করেন ভোলা জেলার বাসিন্দা মওলানা দেলোয়ার হোসেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি কোরআন পাঠ ও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের তাফসির পড়তেন। ঈদের জামাতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী, বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল ও অন্যরা অংশ নেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তুমুল জনপ্রিয় কথিকা অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’–এর এম আর আখতার মুকুল তাঁর ছেলেকে নিয়ে ঈদের জামাত পড়েছিলেন কলকাতার গড়ের মাঠে। নামাজ শেষ করে তিনি যান থিয়েটার রোডে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে। ততক্ষণে সেখানে ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে মাত্র। চল্লিশ থেকে একাত্তর বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘…আমরা যখন থিয়েটার রোডে পৌঁছলাম, তখন কেবল নামাজ শেষ হয়েছে। তাই প্রায় সবার সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। এরপর সবার মুখে অশ্রুভেজা কণ্ঠে কেবল রণাঙ্গন ও ঢাকার আলাপ। প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করলাম, দৈহিকভাবে আমরা সবাই মুজিবনগরে থাকলেও আমাদের মনপ্রাণ সবই পড়ে রয়েছে দখলীকৃত বাংলাদেশে।’
স্মৃতিকথায় নজরুল ইসলাম আরও লেখেন, ‘সরকারিভাবে আয়োজিত ঈদুল ফিতরের এই জামাতে কেবল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছাড়া ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কিংবা কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় অন্য কোনো নেতা যোগদান করেননি।’ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলকাতায় ঈদের নামাজ পড়েননি—বিষয়টি অনেকটা আক্ষেপের মতো করেই নজরুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকথায় বর্ণনা করেছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সেদিন ঈদের নামাজ পড়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়। সেখানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের ঈদ উদ্যাপনের ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘আমরা আগামী ঈদ (কোরবানির ঈদ) করব বাংলাদেশে।’ তাঁর এই কথা সত্য হয়েছিল। আমার একাত্তরের ঈদ বইয়ে এ বিষয়ে সবিস্তার লেখা আছে।
ঈদের খাবার
প্রবাসী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ঈদের বাণী, নামাজ, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয় অনাড়ম্বরভাবে। খাবারদাবারেরও তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। নজরুল ইসলামের একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা থেকে জানা যায়, সকালে তাঁদের ব্যারাকে নিম্নমানের সেমাই রান্না করা হয়। গোস্ত বা পোলাও খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অন্তত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ভালো খাবারদাবারের আয়োজন থাকবে—এমন আশা নিয়ে কেউ কেউ সেখানে গিয়ে হতাশ হন। এদিন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর দপ্তরে খাবারের আয়োজন তো দূরে থাক, নিজেই খাবার মুখে তোলেননি। তাঁর আচরণ ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। ঈদের নামাজ আদায়ের বাইরে অন্য সব আনুষ্ঠানিকতা থেকে বিরত থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঈদের দিন শুভেচ্ছা হিসেবে বিভিন্ন ফল, মিষ্টি ও অন্য শুকনা খাবার পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। কিন্তু দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার পর এখানেও ব্যতিক্রম ছিলেন তাজউদ্দীন। দেশ ও যুদ্ধরত অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা চিন্তা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শুভেচ্ছা খাবারও স্পর্শ করেননি তিনি, সবই অফিসের লোকজনের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তবে দিনশেষে ঈদের খাবার তিনি খেয়েছিলেন, সেটা বাংলার মাটিতে, ঈদের দিনগত মধ্যরাতে গোপন সফরে কুষ্টিয়ার এক জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।
কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তাজউদ্দীন আহমদকে গভীর রাতে নিয়ে যান কুষ্টিয়ার রণাঙ্গনে। সেখানে তিনি অশ্রুভেজা চোখে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে জড়িয়ে ধরে ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করেন। পরিবেশটা কেমন আবেগঘন ছিল, তা ফুটে উঠেছে তাঁর সফরসঙ্গী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথায়, ‘…প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন পরম শ্রদ্ধাভরে আনন্দাশ্রু মিশ্রিত এক আবেগ-আপ্লুত অনুভূতি নিয়ে পা রাখলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে।…ক্যাম্পের অফিসার এসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কোনো প্রটোকলের ধার ধারলেন না। বুকে জড়িয়ে ধরলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে। তারপর ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে একজন একজন করে অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। তাদের সঙ্গে বুক মেলালেন। আমাদের সকলের চোখে আনন্দাশ্রু।…মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই গভীর রাতে কোলাকুলির ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান সুজিত ক্যামেরার সুইচ টিপে দিলে ফ্লাশগানের ঝলসানো আলোতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দুচোখে চিক চিক করে ওঠা অশ্রু কারও দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রী রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। আমরা কেউ কেউ চোখের অশ্রু সংবরণ করে রাখতে পারিনি।’
নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথা সূত্রে আরও জানা যায়, এরপর মুক্তিবাহিনীর রান্না করা সেমাই খান সারা দিন উপোস থাকা তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর গাড়িবহরে করে আনা ফলমূল, বিস্কুট ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করেন। জঙ্গলে অখ্যাত-অজানা লতাপতা ও ফুল দিয়ে বানানো মালা মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রী আরেকবার চোখের জলে ভেসে বলেন, ‘মালা আমি নিই না, মালা পাবেন বঙ্গবন্ধু। তবু আজকের রাতে এই মালা আমি নেব। বাংলার বনবাদাড়ের গাছগাছড়ার ফুল দিয়ে তৈরি এ রাতের মালা আমি নেব। আজ যদি আমার মরণ হয়, অন্তত এই সান্ত্বনাটুকু নিয়ে আমি মরতে পারব যে মুক্ত বাংলার মাটিতে জন্মানো একটি গাছের ফুলের মালা গলায় নিয়ে আমি মরতে পারলাম।’
কলকাতায় প্রবাসী সরকারের একাত্তরের ঈদ ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতার। কারণ সবাই বিভোর ছিলেন দেশ স্বাধীন করার স্বপ্নে। তাই ঈদের চিরাচরিত যে উৎসবের আবহ থাকে, তা কাউকেই সেভাবে স্পর্শ করেনি।
ঈদ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাণী
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাণী গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় ১৯ নভেম্বর ১৯৭১, ঈদের আগের দিন।
সাপ্তাহিক জয় বাংলার ২৮তম সংখ্যার প্রথম পাতায় ‘এই ঈদের আমাদের প্রার্থনা হোক’ শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বাণী ছাপা হয়। একই সংখ্যার দ্বিতীয় পাতায় ‘উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ’ শিরোনামে সম্পাদকীয় কলামের পাশে প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণী। যদিও বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলে বন্দী। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচারিত এই বাণী প্রকাশ ছিল আনুষ্ঠানিকতার অংশ।
বঙ্গবন্ধুর বাণীতে লেখা হয়, ‘আমি নিজেকে বাঙালি ভাবতে গর্ববোধ করি।…বাঙালি হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোনো বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার। জাতি পরিচয় আমার সমষ্টিগত ঐতিহ্য…।’
আরো পড়ুন : কুমিল্লায় গোলাবাড়ি ঈদের জামাতে প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত মোস্তাক