জইর বলসোনারো, লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট। নিজে করোনার টিকা না নেওয়া, এমনকি জনগণকে টিকা নিতে নিরুৎসাহিত করা, অর্থনৈতিক সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ নানা বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য আলোচিত তিনি। তবে ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে নীরব রয়েছেন বলসোনারো। সমসাময়িক কোনো বৈশ্বিক ইস্যুতে বলসোনারোর এভাবে মুখ বন্ধ রাখাটা অনেকটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিয়েছে ব্রাজিল। তাই এ বিষয়ে বলসোনারো এমন আচরণ করছেন, যা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে যায় না। কিন্তু কেন বলসোনারোর এমন নিরপেক্ষ অবস্থান? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিশ্লেষকেরা।
আন্তর্জাতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ঐতিহ্য রয়েছে ব্রাজিলের। এটা এমন একটি দেশ, যারা সহজে কোনো পক্ষ নেবে না।
ইলেনা লাজারোউ, থিঙ্কট্যাংক চাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো
কৃষিতে ব্রাজিল বেশ পোক্ত অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি খাতে রাশিয়া ও ইউক্রেনও বেশ সমৃদ্ধ। বিশ্বজুড়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্য এ দুটি দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়। কৃষির জন্য অত্যাবশ্যক সার রপ্তানিতেও বড় শক্ত অবস্থান রয়েছে রাশিয়ার। তাই চলমান সংঘাতে বলসোনারোর ব্রাজিলের নিরপেক্ষ অবস্থানের একটি বড় কারণ কৃষি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
গত মাসের মাঝামাঝিতে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় বলসোনারোর সঙ্গে বৈঠক করেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা। ওই বৈঠকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় সারের সরবরাহ বাধাহীন রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেন। বৈঠক শেষে এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা নিজেই সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে এক বৈঠক করেন ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে আরও খাদ্য সরবরাহ করার জন্য ব্রাজিলের মতো কৃষিতে শক্তিশালী দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
বলসোনারো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ডব্লিউটিওর মহাপরিচালকের ওই বৈঠকের আলোচনা ব্রাজিলের বর্তমান রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। চলতি বছরের শেষভাগে ব্রাজিলে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রার্থী হবেন বলসোনারো। নির্বাচনের আগে দেশের ভেতরে–বাইরে চাপে রয়েছেন তিনি।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করায় মনোযোগ দিয়েছেন তিনি। তাই ইউক্রেন ইস্যুতে কৌশলগত নিরপেক্ষতার নীতি তাঁর।
স্বার্থের মূলে কৃষি
ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মরিসিও সানতোরো বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে ব্রাজিলের বেশ শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষত দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ মজবুত। ব্রাজিলের কৃষিতে প্রয়োজনীয় সারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধে ব্রাজিলের অবস্থান নির্ধারণের পেছনে এটা বড় একটি কারণ।
সয়াবিনের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল। দেশটিতে উৎপাদিত সয়াবিন বিভিন্ন দেশে পশুখাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। ব্রাজিলের সরকারি তথ্যমতে, গত বছর দেশটি থেকে রেকর্ড ৮ কোটি ৬০ লাখ টন সয়াবিন রপ্তানি হয়েছে। এর দুই–তৃতীয়াংশের বেশি গেছে চীন, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে।
সয়াবিন, ভুট্টাসহ বিভিন্ন শস্য এবং আখ ও তুলা উৎপাদনে প্রতিবছর ব্রাজিলের যে পরিমাণ সার প্রয়োজন হয়, তার ৮৫ শতাংশ আমদানি করে দেশটি, যার পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টন। এর ২৩ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। এটা ব্রাজিলের সরকারের সরবরাহ করা তথ্য।
ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। তাদের লক্ষ্য, রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাপে ফেলা। আর মস্কোকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা। এটা ব্রাজিলের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। বলসোনারো সরকার মনে করছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে সার আমদানি ব্যাহত হলে কৃষি খাত সংকটে পড়বে। নির্বাচনের বছরে সংকটে পড়তে পারে ব্রাজিলের পুরো অর্থনীতি।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলে সারের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই সময় দেশটিতে চাষাবাদের ২০২২–২৩ মৌসুম শুরু হবে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি। এতে সেচের খরচও বাড়বে। একই সঙ্গে সার ও সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ার চাপ সামলানো বলসোনারোর জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে।
ব্রাজিলের বাণিজ্যবিষয়ক শীর্ষ সংবাদপত্র ভ্যালর ইকোনমিকো–তে গত মাসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আর্থিক খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্টোনএক্স জানিয়েছে, রাশিয়ার সারের ওপর এখনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পরও রাশিয়া থেকে ব্রাজিলে সার আমদানি অব্যাহত রয়েছে।
তবে উদ্বেগের বিষয়, সার আমদানিতে অর্থ লেনদেনে সমস্যা আমদানিকারকদের মধ্যে ভীতি বাড়িয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, এ সমস্যার কারণে আমদানি ব্যাহত হয়ে সারের সংকট দেখা দিতে পারে। এর ফলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলে সারের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই সময় দেশটিতে চাষাবাদের ২০২২-২৩ মৌসুম শুরু হবে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি। এতে সেচের খরচও বাড়বে। একই সঙ্গে সার ও সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ার চাপ সামলানো বলসোনারোর জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, তখনো ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হয়নি। বলসোনারো মস্কো সফর করেন। বৈঠক করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তুমুল সমালোচনা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের মস্কো সফর ঠেকাতে পারেনি। এমনকি তাঁর সরকারের মন্ত্রীরাও এ সফরের সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বলসোনারোর সমর্থকদের মধ্যে ব্রাজিলের কৃষি–ব্যবসা খাতের প্রভাবশালী একটি অংশ রয়েছে। মস্কো সফরে তাঁদের উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর বলসোনারো বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য সার পাওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এ যুদ্ধে কারও পক্ষ নেব না। আমরা নিরপেক্ষ থাকব। তবে সংকট সমাধানে জন্য গৃহীত যেকোনো উদ্যোগে সহায়তা করব।’
কূটনৈতিক ঐতিহ্য
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে বলসোনারো নতুন কোনো কৌশল নেননি। তিনি ব্রাজিলের কূটনৈতিক ঐতিহ্য মেনে চলছেন। এ বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চাথাম হাউসের আমেরিকাস প্রোগ্রাম অ্যাট ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহযোগী ফেলো ইলেনা লাজারোউ বলেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ঐতিহ্য রয়েছে ব্রাজিলের। এটা এমন একটি দেশ, যারা সহজে কোনো পক্ষ নেবে না।
বলসোনারোর আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লুলা ডি সিলভা ও দিলমা রুসেফ। তাঁদের আমলেও ব্রাজিল রাশিয়াবিরোধী ছিল না। ব্রিকস জোটের অন্যতম সদস্য ব্রাজিল। এ জোটের বাকি দেশগুলো হলো রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
তাই ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর কূটনৈতিক ঐতিহ্য মেনে ব্রাজিল নিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলছে। এমনটাই মনে করছেন ইলেনা লাজারোউ। তবে ভিন্নমত রয়েছে বলসোনারো সরকারের ভেতরেই। ব্রাজিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যামিলটন মোউরাও ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন। এমনকি তিনি পুতিনকে জার্মানির নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্টের এমন মনোভাবের সমালোচনা করেছেন বলসোনারো।
মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগ
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব অর্থনীতি চাপের মুখে পড়েছে। গত সপ্তাহে আইএমএফ চলতি বছরের বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে এনেছে। তবে একই সময়ে ব্রাজিলের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৮ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ বলছে, যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে পণ্য বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ধারা বজায় রয়েছে। রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে এতে ব্রাজিলের লাভ হবে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তা ভূমিকা রাখবে।
তবে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ব্রাজিলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম নির্বাচনের বছরে বলসোনারোর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কমতির দিকে রয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তা। দেশটিতে সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তার নিরিখে বলসোনারোর তুলনায় লুলা ডি সিলভা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। তাই বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, দুই মেয়াদে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা লুলা ডি সিলভা আগামী নির্বাচনে বলসোনারোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেন।
নিউইয়র্কভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেডলি গ্লোবাল অ্যাডভাইজার্সের ব্রাজিলবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মারিও সার্জিও লিমা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ব্রাজিলের সামনে যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা জ্বালানির বাড়তি দাম। খাদ্য সরবরাহ, কৃষি, পরিবহনসহ দেশটির সব খাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বেড়েছে খাবারের দামও। আর এ জন্য ব্রাজিলের জনগণ প্রেসিডেন্ট বলসোনারোকে দায়ী করছেন। তাই নির্বাচনের বছরে তাঁকে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা নিয়ে লড়তে হচ্ছে। সেটাও ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে।
আরো পড়ুন : মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম