দীর্ঘ ২০ বছর কারাগারে থাকার পর ২৮ মে মুক্তি পেয়েছেন ফুসাকো শিগেনোবু। জাপান ও বিশ্বের অনেক দেশের তরুণদের কাছে নামটি অপরিচিত হলেও গত শতকের সত্তরের দশকে তরুণ প্রজন্মের অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন এই নারী। আবার অনেকের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ঘৃণার পাত্র।
৭৬ বছর বয়সী ফুসাকো প্রথম আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছিলেন ১৯৭২ সালে, ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের লড বিমানবন্দরে চালানো সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে। সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২০ জনের বেশি। আহতের তালিকায় ছিল আরও প্রায় ৮০ জনের নাম।
হামলাটি চালায় জাপানের নিষিদ্ধ ঘোষিত চরম বামপন্থী একটি সংগঠন। সংগঠনটি নিজেদের ‘রেড আর্মি’ নামে পরিচয় দিয়েছিল। প্রথম দিকে রেড আর্মির কথা জাপানের বাইরে তেমন শোনা না গেলেও হামলার পর তারা পরিচিত হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রেড আর্মির কয়েকজন সদস্য তেল আবিবে ওই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাঁর নাম প্রচারিত হতে থাকে, তিনি হলেন ফুসাকো শিগেনোবু। ফুসাকো ছিলেন রেড আর্মির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, কারও কারও মতে মূল প্রতিষ্ঠাতা।
গত শতকের ষাটের দশক জাপানের জন্য ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সমাজের সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার উত্তাল এক সময়। দেশে মার্কিন সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সুযোগ সম্প্রসারিত করে দেওয়া নিয়ে জাপান সরকারের নীতি তাঁদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধও তাঁদের সরকারবিরোধী মনোভাবের পেছনে বাড়তি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সহায়ক শক্তি ছিল জাপান। সে সময় জাপানের নেওয়া বিভিন্ন নীতি সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাজনীতির সনাতন পথ ছেড়ে তাঁদের একটি অংশ ক্রমেই ঝুঁকে পড়তে শুরু করে চরমপন্থার দিকে। জাপানি রেড আর্মির জন্ম সে পথ ধরেই।
ফুসাকো শিগেনোবুর জন্ম ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঠিক পরে। জাপানজুড়ে তখন ক্ষুধা আর দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফুসাকোর বাবা ছিলেন দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের কিউশু দ্বীপে দরিদ্র শিশুদের একটি স্কুলের শিক্ষক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ফুসাকোর বাবাকে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হয়। যুদ্ধের পরে কঠিন সময়ে একটি মুদি দোকান চালিয়ে কোনোমতে সংসারের খরচ মেটাচ্ছিলেন তিনি। বাল্যকালের সেই সময় ফুসাকোর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যা পরে তাঁকে ঠেলে দেয় রাজনৈতিক চরমপন্থার দিকে।
হাই স্কুলের পাঠ শেষ করে জাপানে সয়া সস তৈরির নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ‘কিক্কোমানে’ অফিসকর্মী হিসেবে যোগ দেন ফুসাকো। পরে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে টোকিওর মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেই ঘটনাচক্রে বামপন্থী রাজনীতির সরাসরি সংস্পর্শে আসেন তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা সেই সময়ের তরুণদের বড় এক অংশকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। ফুসাকো নিজেও সেই দলে ছিলেন।
জাপানের সনাতন বামপন্থী রাজনীতিতে তখন ছিল সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্য। তবে ফুসাকোর মতো বাম রাজনীতির চরমপন্থার দিকে আকৃষ্ট হওয়া তরুণেরা দুই দলকেই দেখেছিলেন ক্ষমতাসীন মহলের বর্ধিত একটি অংশ হিসেবে। ফলে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন নিয়ে তাঁদের একটি দল রেড আর্মি গঠন করে বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেন। আর অল্প দিনের মধ্যেই ফুসাকো দলের নেতৃত্বে চলে আসেন।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে দেখা দেওয়া বিভক্তি ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে জাপানের রেড আর্মিও মুক্ত ছিল না। সত্তরের দশকের শুরুতে জাপানের এক পার্বত্য অঞ্চলে একটি গোপন ঘাঁটিতে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে রেড আর্মির বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হওয়ার খবর জাপানে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
ওই ঘটনার পর থেকে রেড আর্মির বিরুদ্ধে পুলিশের তৎপরতা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের একটি অংশ পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে কারারুদ্ধ হন। এর জেরে ১৯৭১ সালের শুরুতে ফুসাকো দেশ ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সংগ্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। জাপানের বাইরে বিভিন্ন দেশে রেড আর্মির সন্ত্রাসী হামলার শুরু সেখান থেকেই।
তেল আবিবের ঘটনার পর ১৯৭৪ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগে ফরাসি দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গেও ফুসাকো সরাসরি জড়িত ছিলেন। ওই হামলায় রেড আর্মির সদস্যরা ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ও প্রায় ১০ জন কূটনীতিককে জিম্মি করেন। পরে ফ্রান্সের কারাগারে আটক তাঁদের এক সদস্যের মুক্তির বিনিময়ে জিম্মি করা ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
তত দিনে লেবাননে রেড আর্মির ঘাঁটি গড়ে নিয়েছিলেন ফুসাকো। সেখান থেকে হামলা ও পরবর্তী সময়ে চলা আলোচনায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। তাঁর সাফল্য দেশের বাইরে রেড আর্মির সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে সহায়তা করেছিল। পাশাপাশি জাপান ও কয়েকটি দেশে আটক দলের সদস্যদের মুক্তি নিশ্চিত করতে হামলা চালানোয় অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
১৯৭৫ সালে রেড আর্মির সদস্যরা মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে যুক্তরাষ্ট্র ও সুইডেন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে জাপানে আটক দলের কয়েকজন সদস্যের মুক্তি দাবি করেন। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাপান এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করে ঢাকায় নিয়ে আসার ঘটনায় জাপানের রেড আর্মি জড়িত ছিল।
জাপান সরকার ওই উড়োজাহাজের যাত্রীদের মুক্তির বিনিময়ে রেড আর্মির কয়েকজন সদস্যকে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়াও বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করে ওই ঘটনার নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। এর কয়েক বছর পর ১৯৮৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার জাপান দূতাবাসে মর্টার হামলা এবং ১৯৮৮ সালে ইতালির নেপলসে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি ক্লাবে হামলার সঙ্গেও রেড আর্মি সরাসরি জড়িত ছিল।
তত দিনে বিশ্ব রাজনীতিতে বইতে শুরু করা পরিবর্তনের হাওয়া রেড আর্মিকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করে দেয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া দলটিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছিল। লেবাননের রাজধানী বৈরুতও তখন আর আগের সেই বৈরুত ছিল না। এ অবস্থায় ফুসাকো শিগেনোবু অনেকটা যেন বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে যান।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও নতুন বাঁক লক্ষ করা যায়। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া থেকে নিজেকে তিনি অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে নেন। ১৯৭৩ সালে পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের একজন সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকে জন্ম নেওয়া মেয়ে মেইকে নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে সময় কাটাতে শুরু করেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে গোপনে জাপানে ফিরে আসেন ফুসাকো। শুরুতে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলেও ২০০০ সালের নভেম্বরে জাপানের পুলিশ তাঁকে ওসাকা শহর থেকে আটক করে। এরপর দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে আদালত তাঁকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন।
কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় ফুসাকোর জীবনে আরেকটি বাঁক দেখা যায়। ২০০২ সালে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি রেড আর্মি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এরপর থেকে কার্যত রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। কারাগার থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে নিজের অতীত কার্যকলাপ যে ভুল ছিল, তা স্বীকার করেও নিয়েছিলেন।
২০১৭ সালে জাপানের একজন সাংবাদিকের কাছে লেখা চিঠিতে তাঁর দল যে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তা স্বীকার করেছিলেন ফুসাকো। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের আশা পূর্ণতা পায়নি এবং কদর্য এক পরিণতির মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে।’
উল্লেখ্য, রেড আর্মির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অনেককেই দেশে-বিদেশে মর্মান্তিক পরিণতির মুখে পড়তে হয়েছিল। এখনো জাপানের পুলিশ পলাতক আটজনের সন্ধান করছে। ফলে বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন ভঙ্গের যে বার্তা ফুসাকো মুক্তির আগে দিয়েছিলেন, তা সম্ভবত ছিল এই করুণ পরিণতির জন্য নিজের দায়বদ্ধতা মেনে নেওয়ার একটি চেষ্টা।
আটক অবস্থায় ২০০৮ সালে ফুসাকোর দেহে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর চারটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। দণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের কয়েক বছর টোকিওর কারা হাসপাতালে থেকেছেন তিনি। সেখান থেকেই গত শনিবার মুক্তি পান।
ফুসাকোর মুক্তির খবর এর আগেই প্রচার করা হয়েছিল। কারা হাসপাতালের কাছের একটি পার্কে সকাল থেকেই সাংবাদিকদের পাশাপাশি শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে স্বাগত জানাতে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ফুসাকো বলেন, ‘যাঁরা আমার পরিচিত নন, তাঁদের ক্ষতি করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এখন থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার দিকে আমি মনোযোগ দেব এবং দ্রুত সব কিছু জেনে নেওয়ার চেষ্টা করব।’
মুক্তি পাওয়ার আগে মেয়ে মেইয়ের মাধ্যমে প্রচারিত এক বার্তায় আবারও তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন। তবে একই সঙ্গে এমনও তিনি উল্লেখ করেন, মানুষের মঙ্গলের জন্য বিশ্বকে বদলে দেওয়ায় নিজের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে জীবন কাটাতে পারায় তিনি কৃতজ্ঞ। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে যাপিত সময়ের একজন সাক্ষী হিসেবে কিছু বলার অনুরোধ করা হলে সেই অনুভূতি পৌঁছে দেওয়ার ভূমিকা আমি পালন করব।’
ধরে নেওয়া যায়, নিজের অতীত নিয়ে ফুসাকোর নিজের করা মূল্যায়ন একই সঙ্গে জাপানে একটি ধারার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টেনে দিয়েছে। যদিও সেই ধারার সক্রিয় কোনো উপস্থিতি গত তিন দশকে সেভাবে দেখা যায়নি। আর তাই ফুসাকো শিগেনোবুর পরিণতিকে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক আখ্যায়িত করতে হয়।
সুত্র-প্রথম আলো
আরো পড়ুন : রাগ করে বাড়ি ছাড়ল ৪ বোন, খুঁজছেন স্বজনরা